08-05-16-PM_Open Hill Track Complex-6

কেবল ভূমিসংস্কার ছাড়া পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।চুক্তি অনুযায়ী চারটি ব্রিগেড ছাড়া বেশির ভাগ সেনা ক্যাম্পও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।রোববার সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবের পার্শ্ববর্তী স্থানে নির্দিষ্ট দুই একর জমির ওপর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।শেখ হাসিনা বলেন,সরকার ভূমিসংস্কারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন একাধিকবার গঠন করেছে। কিন্তু কমিশনের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোয়নি। কারণ, সেখানে কিছুটা অবিশ্বাস ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, সেনা ক্যাম্পগুলো বেশির ভাগই তুলে নেওয়া হয়েছে। চারটি জায়গায় কেবল চারটি ব্রিগেড থাকবে। বাকিগুলো সব সরিয়ে নেওয়া হবে। এ জন্য রামুতে একটি সেনানিবাস করা হয়েছে। ওই অঞ্চলে তাঁর সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন ২০০১-এর কতিপয় সংশোধনীর বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে পর্যালোচনা চলছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সম্ভব সবকিছু করতেই সরকার প্রস্তুত রয়েছে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও বাংলাদেশের নাগরিক। সরকার ওই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ খাত এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন,চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী।অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা।প্রায় দুই একর জমির ওপর নির্মাণাধীন এই পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স প্রকল্পে ছয়তলা ভবন, মাল্টিপারপাস হল, ডরমিটরি, প্রশাসনিক ভবন,জাদুঘর,গ্রন্থাগার, ডিসপ্লে সেন্টার, থিয়েটার হল,পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বাসভবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসভবন থাকবে।পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর চারটি ব্রিগেড রেখে সব ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে সরিয়ে আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এখনও যেসব কাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো শেষ করার আশ্বাস দিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতিকে আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। হাসিনা বলেন,সেনা ক্যাম্পগুলোর অধিকাংশই আমরা তুলে নিয়েছি। চারটা জায়গায় চারটা ব্রিগেড থাকবে। বাকিগুলো আমরা তুলে নিয়ে আসব। সে লক্ষ্য নিয়েই রামুতে একটি সেনানিবাস করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে।সরকার ওই চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়নের কথা বলে এলেও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও ১৯ বছরেও তা হয়নি।চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলীর সকল দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান নির্বাহী আদেশে হস্তান্তর করা, আঞ্চলিক পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সংশোধনসহ বেশ কিছু শর্তও এখনো পূরণ করা হয়নি বলে জনসংহতি সমিতির অভিযোগ।

বেইলি রোডে ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানের শুরুতেই জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল, উদ্বেগজনক, হতাশাব্যাঞ্জক। অবিশ্বাস ও সন্দেহের দূরত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে; পার্বত্যবাসীর মনে হতাশা ও নিরাশা চেপে বসেছে।আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্বে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্ভব হলো, তেমনিভাবে তার বিজ্ঞ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যারও যথাযথ সমাধান হতে পারে।

পরে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় চুক্তি বাস্তবায়নে আলোচনার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুপক্ষকেই বসে ঠিক করতে হবে। ২০০১ সালে আমরা যে আইনটা করেছিলাম, সেখানে তারা কিছু সংশোধন চেয়েছেন। সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে যতটুকু করা সম্ভব, সেটা আমরা করে দেব।তিনি প্রশ্ন করেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন অশান্তি থাকবে’।প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেখানে এক হাজার ৩৬৯ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। ৮৭৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য ৮৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।১৯৭৬ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ’ বাতিল করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪’ প্রণয়ন করায় বোর্ডের কার্যপরিধি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন,পাহাড়ের জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে তার সরকার রাঙ্গামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে।প্রত্যন্ত এলাকায় আবাসিক সুবিধাসহ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে।ইতিমধ্যে নতুন উপজেলা গুইমাড়া, নতুন থানা সাজেক এবং নতুন ইউনিয়ন বড়থলি গঠন করেছি।

আওয়ামী লীগের গত ২০০৯-১৪ সরকারের সময়ই সার্কেল চিফের সম্মানী এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, হেডম্যানদের সম্মানী ১০০ থেকে ১ হাজার টাকায় উন্নীত করা এবং কারবারিদের জন্য ৫০০ টাকা সম্মানী চালু করার কথা মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।

বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাবের পশ্চিম পাশে প্রায় দুই একরের যে জমিতে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কমপ্লেক্স নির্মাণ হচ্ছে, সেটি পাওয়া ‘সহজ হয়নি’ বলে সরকারপ্রধান জানান।আপনারা জানেন যে পাশে অফিসার্স ক্লাব। সেই প্রথম থেকে, যখন প্ল্যান হচ্ছে তখন আমি বলেছি যে, এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কমপ্লেক্স করা হবে। কিন্তু, আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এটা পাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। শুধু প্যাঁচ আর প্যাঁচ…।ঘটনাটা কী? ঘটনা আর কিছুই না।অফিসার্স ক্লাব এখান থেকে জায়গা নিতে চায়। আমি তাদের বলেছি, এই জায়গা আপনার পাবেন না। কেউ পাবেন না।

জায়গাটি নিয়ে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখানে চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট- তার বাংলো ছিল।গোলপাতার ছাউনি দেওয়া কাঠের ঘর, তার সামনে বিশাল বাগান। ওই বাগানে ছোটবেলায় আমাদের অনেক খেলাধুলা করার সৌভাগ্য হয়েছে। চুয়ান্ন সালে আমার বাবা যখন মন্ত্রী ছিলেন, মিন্টো রোডে ছিলেন, আমরা তখন এখানে আসতাম। ছাপান্ন সালে যখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি আব্দুল গণি রোডে ছিলেন, তখনও আমরা এ জায়গায় এসেছি।বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, অনেক কষ্টে এই জায়গাটা উদ্ধার করে অবশেষে কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটা আমার কাছে নির্দিষ্ট ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি, তাদের জীবনমান সবকিছুর যেন প্রতিফলন ঘটে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে দ্রুত কমপ্লেক্সের কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দরকার হলে ডাবল শিফটে কাজ করান।বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব মা দিবসে সব মা’য়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আমার পিতা জেলখানায় বন্দী থাকাবস্থায় তিনিই পরিবারকে আগলে রেখেছেন। দলের নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করেছেন।প্রধানমন্ত্রী ২৫ শে বৈশাখে করিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার ১৫৫তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ করেন।এর আগে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছলে তার হাতে ফুল তুলে দিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে স্বাগত জানান অনুষ্ঠানের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ফলক উন্মোচন করেন শেখ হাসিনা।অনুষ্ঠানে কমপ্লেক্সের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘চিটাগং হিল ট্রাক্টস: লং ওয়াক টগ পিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পর সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও উপভোগ করেন।