সাঁড়াশি অভিযানে পুলিশ

জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামছে পুলিশ। দেশব্যাপী এ অভিযান আগামীকাল শুক্রবার থেকে শুরু হবে। চলবে সাত দিন।বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে পুলিশ সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এ বৈঠক চলে।বৈঠকে অতিরিক্ত আইজিপি ফাতেমা বেগম, সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হিমায়েত হোসেন, রেলওয়ে রেঞ্জের অতিরিক্ত আইজিপি মো. আবুল কাশেম, ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, সব কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি এবং ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, বগুড়া, ঝিনাইদহ ও নাটোর জেলার পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।আইজিপি বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা জোরদার করতে হবে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিউনিটি পুলিশিংকে কাজে লাগাতে হবে।বাবুল আক্তারের স্ত্রী খুনের ঘটনাকে অত্যন্ত নির্মম, বর্বরোচিত ও দুঃখজনক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন আইজিপি। তিনি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেন। দৃঢ় মনোবল নিয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, টিম স্পিরিট নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।সভায় দেশব্যাপী জঙ্গিদের তালিকা হালনাগাদ করা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো, ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশিংকে কার্যকর করা, আগন্তুক ও ভাড়াটেদের ওপর নজরদারি বাড়ানো, বিদেশিদের নিরাপত্তা দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। শহরে বা গ্রামে কোথাও নিরাপত্তা নেই। টার্গেট করে খুন করা হচ্ছে। ধরা পড়ছে না খুনিরা। এমন পরিস্থিতিতে দারুণ উত্কণ্ঠার মধ্যে দিন পার হচ্ছে সাধারণ মানুষের। বিশ্লেষকরা বলছেন, উগ্রপন্থিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে না পারলে কোনো প্রতিরোধই কাজে আসবে না। আর জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে শুধু পুলিশ নয়, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকেও একযোগে কাজ করতে হবে। শুধু পুলিশের একার পক্ষে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। হঠাত্ করেই র‌্যাব যেন নীরব হয়ে গেছে। র‌্যাবের এই নীরবতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কয়েকদিনে কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। তবে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। পাশাপাশি বিজিবিও নামানো হয়েছে। সমন্বিতভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। এসব অভিযানের ফলও শিগগিরই পাওয়া যাবে।নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আক্রমণাত্মক হতে হবে। সম্মিলিতভাবে অপারেশন চালাতে হবে। ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলার পর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেভাবে সর্বাত্মক অভিযান চালানো হয়েছিল, এখন সেভাবেই অভিযান চালাতে হবে। নইলে ওদের টার্গেট কিলিং বন্ধ করা যাবে না। আর একটা বিষয়, জঙ্গিদের সঙ্গে শিবিরের একটা সখ্যতা দেখা যাচ্ছে। সারাদেশে শিবিরের একটা নেটওয়ার্ক আছে। জঙ্গিরা এখন ওই নেটওয়ার্ক কাজে লাগাচ্ছে। অনেক জায়গায় জঙ্গিদের প্রোফাইলে শিবিরের পরিচয় মিলছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান (প্রশাসন) বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান পুলিশ বসে নেই। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু নেই। সম্মিলিতভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আপনার পাশের কাউকে সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানান। তাহলেই জঙ্গিরা-অপরাধীরা পিছু হটবে। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ফল মিলবে।

একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী নিহত হওয়ার পর পুলিশ সদস্যরাও জঙ্গি দমনে উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু অন্যান্য সংস্থা বা বাহিনীর তত্পরতা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতির পরও নীরব রয়েছে র্যাব। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গঠিত বিশেষায়িত এই বাহিনী জন্মের পর থেকেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। র্যাব মাঠে নামার পর অপরাধীরা কারাগারকেই অধিকতর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মনে করত। অথচ এখন অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশজুড়ে। কিন্তু র‌্যাবের তেমন তত্পরতা দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমিত জনবল নিয়ে পুলিশ অপরাধীদের মোকাবেলায় পেরে উঠছে না। এখানে র‌্যাবকে আরো কার্যকরভাবে মাঠে নামতে হবে। কারণ জঙ্গি দমনের বিষয়ে র‌্যাবের অভিজ্ঞতা রয়েছে, রয়েছে সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় গবেষণা। মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, আমরা দেখেছি র‌্যাব গঠনের পর তারা অনেক বেশি আক্রমনাত্মক ছিল। জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তারা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। কোন জঙ্গি সদস্য রাতে ঘুমাতে পারত না। কিন্তু হঠাত্ করেই তারা যেন পিছু হটেছে। এর কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, তাদের এই আক্রমনাত্মক হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠন র‌্যাব ভেঙে দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। আসলে আমাদের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে র‌্যাব ভাঙলে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। আসলে বিতর্কের চেয়ে আমাদের দরকার নিরাপত্তা। র্যাব আক্রমনাত্মক হলে দেশের মানুষের নিরাপত্তা যদি বাড়ে তাহলে আমার তো মনে হয় আক্রমানাত্মক হওয়াই ভালো। যদিও আক্রমনাত্মক হলে জান-মালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবুও নিরাপত্তার জন্য এটা দরকার।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। এক পর্যায়ে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতেও কোন কাজ হয়নি। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ মাঠে নামে বিশেষায়িত বাহিনী র‌্যাাব। র্যাবের প্রথম ক্রসফায়ারে মারা যায় পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান। এরপর আরো কয়েকজন ক্রসফায়ার হওয়ার পর আলোচনায় আসে র্যাব। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে সন্ত্রাসীরা। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশে স্বস্তি ফিরে আসে।

এর মধ্যেই ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। তখন থেকেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে র‌্যাব। ডিসেম্বরে শায়খ আব্দুর রহমানের ছোটভাই আতাউর রহমান সানি গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাইসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার করে র্যাবই। র‌্যাবের নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে আসে জঙ্গিদের সব আস্তানা। উদ্ধার হতে থাকে জঙ্গিদের হেফাজতে থাকা বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্রসহ সব ধরনের সরঞ্জাম। র‌্যাবের অব্যাহত অভিযানের মুখে নিজেদের নেটওয়ার্ক গুটিয়ে নিতে থাকে জঙ্গিরা। একটা পর্যায়ে দেশে জঙ্গিদের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে। জঙ্গিদের অনেকে কারাগারে আবার অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। শুধু র্যাব নয়, পুলিশও তখন অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে অভিযান চালিয়েছে।এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, র‌্যাব একেবারে চুপচাপ এটা বলা যাবে না। তারা কৌশল পরিবর্তন করেছে। ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। শিগগিরই আরো সক্রিয়ভাবে অভিযানে নামছে র‌্যাব। এ নিয়ে ভুলবোঝাবুঝির কিছু নেই।

র‌্যাবের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মানুষ হতাশ। ফলে র‌্যাাবকে অপরাধীদের দমনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করতে গিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সেখানে অপরাধীরা মারা যাচ্ছে। আবার র্যাব সদস্যরাও আহত হচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা গোলাগুলির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকে তো র‌্যাবকে খুনি বাহিনী বলেও উল্লেখ করেন। অথচ কোন বিশেষজ্ঞই র‌্যাবের আহত সদস্যদের নিয়ে কথা বলেন না। শুধু মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে অপরাধীদের পক্ষ নেন।

ওই কর্মকর্তার মতে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে র‌্যাবও অনেক সময় ভুল করে। এর জন্য অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়। বহু র্যাব সদস্যের শাস্তিও হয়েছে। অনেকের চাকরি চলে গেছে। কিন্তু এসব বিষয় বিশেষজ্ঞরা দেখেন না। ফলে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। ঝুঁকি নিয়ে বড় ধরনের অভিযান চালাতে অনীহা কাজ করে তাদের মধ্যে। এখন আসলে র‌্যাবকে আবার চাঙ্গা করা দরকার। দেশের স্বার্থেই মাঠে নামাতে হবে তাদের।র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) কর্ণেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, আমরা চুপচাপ বা বসে নেই। আমাদের কার্যক্রম আগের মতোই চলছে। অচিরেই মানুষ দেখতে পাবেন র‌্যাাব আসলে কি করছে।