জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খোঁজে গোয়েন্দারা নিখোঁজ ৭৭ তরুণ

রাজধানীর গুলশানে হোটেল আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিদের ঘাঁটি শনাক্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে কমপক্ষে ৭৭ তরুণ নিখোঁজ হওয়ার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাদের নিখোঁজ থাকার বিষয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় অর্ধশতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। ঢাকায় জিডি হয়েছে কমপক্ষে ২৩টি। নিখোঁজদের তালিকায় কিছু উচ্চশিক্ষিত তরুণীও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এদের প্রায় সবাই ধর্মীয় উগ্রপন্থা বেছে নিয়েছে। ঘটাচ্ছে টার্গেট কিলিং ও আত্মঘাতী হামলা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণা তাদের কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যের উগ্রপন্থী সংগঠন আইএসে যোগ দিয়েছে বা আইএসের হয়ে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ দেশে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা অপর কোনো উগ্রপন্থী সংগঠনের হয়ে কাজ করছে। নিখোঁজদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সব থানায় নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০ জনের ছবি, পাসপোর্ট নম্বর ও অন্যান্য তথ্য দিয়েছে পুলিশ। নাম-ঠিকানা জানা গেছে আরও অনেকের।

গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার বিচ্ছিন্ন চরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খোঁজে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। সাম্প্রতিক র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতার জঙ্গি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে আসা জঙ্গিদের দেয়া এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ওইসব স্থানে গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে। এর বাইরে পার্বত্য এলাকার দুর্গম পাহাড়েও জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলতে পারে। ওইসব স্থানেও গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।এদিকে রাজধানীর গুলশানে স্প্যানিশ হোটেল আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী নিহত জঙ্গিদের ডিএনএ ও ভিসেরা পরীক্ষা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আদালতে অনুমতি মিলেছে। চিকিৎসক ও পুলিশ সূত্র জানায়, ওই ছয় জঙ্গির পরিচয় নিশ্চিত হতেই ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। অন্যদিকে হত্যাকান্ডের আগে জঙ্গিরা শক্তিবর্ধক বিশেষ ধরনের কোনো ড্রাগ আসক্ত হয়েছিল কি-না তা নিশ্চিত হতেই হামলাকারী জঙ্গিদের ভিসেরা টেস্ট করা হচ্ছে। কারণ গুলশানের ওই রেস্তোরাঁটিতে জঙ্গিদের নৃশংসতা ও বীভৎসতা কোনো সুস্থ মানুষ চালাতে পারে কিনা এ নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সেক্ষেত্রে ২০ জন মানুষকে বর্বরভাবে হত্যার আগে ওই ছয় জঙ্গি ক্যাপটাগন নামের বিদেশি কোনো বিশেষ ওষুধ খেয়েছিল কি-না-তাও ভিসেরা পরীক্ষায় উঠে আসবে। র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গুলশানের হোটেল আর্টিজান বেকারি, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিত শোলাকিয়া ঈদ জামাতসংলগ্ন পুলিশ চেকপোস্ট ও সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার ঘটনায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের স্থানগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গি শফিউল ও জাহিদুল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এছাড়া এর আগে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি ও প্রশিক্ষণ থেকে পালিয়ে আসা কয়েক তরুণও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। ওই তথ্য মতে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বা সংলগ্ন জেলা শহরে বাসা ভাড়া করে মোটিভেশনাল বা উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। জঙ্গিদের প্রশিক্ষক ও সমন্বয়কারীদের খোঁজে তৎপরতা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতারদের তথ্যের ভিত্তিতে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, বগুড়া ও রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার বিচ্ছিন্ন ও বিস্তীর্ণ চর এলাকায় জঙ্গি অপারেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। সেখানে যাওয়া যুবকদের অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে ধীরে জঙ্গিরূপে প্রস্তুত করা হয়। পরে তরুণ জঙ্গিদের অস্ত্র চালানো শেখায় প্রশিক্ষক। কেন্দ্রগুলোতে একজন প্রশিক্ষক ও একজন সমন্বয়কারী থাকেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এমন খবর জানার পর থেকেই জঙ্গি ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খোঁজে কাজ করছেন গোয়েন্দা সদস্যরা। গাইবান্ধা কিংবা কুড়িগ্রামের যে কোনো একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শোলাকিয়া হামলার প্রশিক্ষণ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলে জঙ্গি ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধানে মাঠে রয়েছেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অসংখ্য সদস্য। এছাড়া পার্বত্য জেলাগুলোর গহিন জঙ্গলেও এমন জঙ্গি কর্মকান্ড চলতে পারে। তাই ওইসব বিচ্ছিন্ন স্থানগুলোতেও ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

একাধিক সূত্র বলছে, উগ্রপন্থি জঙ্গিরা কয়েকটি ধাপে কাজ করে থাকে। প্রথমে টার্গেট করা তরুণদের দলে ভিড়িয়ে করা হয় মগজ ধোলাই। এদের মধ্যে যাদের প্রতিশ্র“তিশীল ও অনুগত বলে মনে হয়, তাদের নেয়া হয় পরবর্তী ধাপে। ওই ধাপে চলে অস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ। নাশকতা চালানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত গোপন আস্তানায় দেয়া হয় ‘বয়ান’। বয়ানে একেক সময় একেকজন ‘বড় ভাই’ অংশ নেন। তরুণদের কাছে দেয়া হয় কোরান ও হাদিসের অপব্যাখ্যা। উদ্বুদ্ধকরণ শেষে জঙ্গিদের পাঠানো হয় ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায়। সেখানে তারা পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, দুই মতাদর্শ অনুসারী জঙ্গিরা দেশে যে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে তার মূলে কলকাঠি নাড়ছে কয়েক মাস্টারমাইন্ড। তারা ৫-৬ জনের একটি গ্র“প করে টার্গেট ব্যক্তিকে হত্যা করতে বা স্থাপনায় হামলা চালাতে জঙ্গিদের পাঠাচ্ছে। একটি গ্রুপ ধরা পড়লে তারা আরেকটি গ্রুপ তৈরি করে ফের জঙ্গি হামলার কলকাঠি নাড়ছে। পেছনের পরিকল্পনাকারীরা ধরা পড়লে এসব সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও পুলিশ ও গোয়েন্দারা মনে করছে। যে কারণে ডিএনএ ও ভিসেরা পরীক্ষা

হলি আর্টিজানে তিন বাংলাদেশিসহ ১৭ বিদেশি নাগরিকের অনেককেই জঙ্গিরা কুপিয়ে ও গুলিতে হত্যা করে হামলাকারী জঙ্গিরা। অপারেশন থান্ডার বোল্ট অভিযানের পর হলি আর্টিজানে ঢুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা হতবাক হয়ে যান জঙ্গিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার আলামত দেখে। তাদের অনেকেই বলেছেন, এমন নৃশংসতা ও বীভৎসতা এর আগে দেখেননি তারা।

জানা গেছে, সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দুর্র্ধষ জঙ্গিরা ক্যাপটাগন নামের একটি ওষুধ সেবন করে। এ কারণে এই ওষুধটি ‘আইএসআইএস ড্রাগ’ নামে পরিচিত। ক্যাপটাগন সেবনের কারণে আইএসের জঙ্গিরা দিনের পর দিন জেগে থাকে। এরপর ঠান্ডা মাথায়, কোনো রকম সহমর্মিতাবোধ ছাড়া একের পর এক মানুষ খুন করতে পারে। ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। ১২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি সংকটের সময় ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের বোমায় নিহত হন ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা। পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত হন হামলাকারী ৬ জঙ্গি। অপরদিকে ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের অদূরে পুলিশ চেকপোস্টে গুলি ও বোমা হামলায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক গৃহবধূ নিহত এবং অন্তত ২০ জনকে আহত করে জঙ্গিরা। শোলাকিয়ায় হাতেনাতে গ্রেফতার জঙ্গি শফিউলের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। র‌্যাব হেফাজতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সে পুরো অপারেশন পরিকল্পনার নানা তথ্য জানিয়ে দিচ্ছে অবলীলায়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে আরও ছয়জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, যারা সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) কিলিং মিশনের সক্রিয় সদস্য। এই ছয়জনের বাইরে তাদের নেতৃত্বে দু’জন বড়ভাই ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এরা তাদের কাছে ওস্তাদ হিসেবে পরিচিত।এছাড়া ‘অপারেশন শোলাকিয়া’য় অংশ নেয়া জঙ্গিদের দেখভালের পুরো দায়িত্বে ছিল জয়নাল আবেদীন ওরফে আকাশের ওপর। হামলার আগে এই আকাশই তাদের জন্য ওই এলাকায় বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা করে রাখে, যাকে বুধবার সন্ধ্যায় দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আটক করতে সক্ষম হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, রিমান্ডে থাকা শফিউলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শোলাকিয়া অপারেশন টিমের পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা হল- বাইক হাসান ওরফে নজরুল, মামা খালেক, বিজয়, গোলাম রাব্বানী, রিয়াজুল ওরফে মেহেদী ও সাদ্দাম ওরফে রাহুল ওরফে চঞ্চল। এদের মধ্যে বাইক হাসানের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে। তাকে ধরতে বগুড়া এলাকায় আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি দল অভিযানে যায়। সেখানে সে ধরা পড়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করছে। তবে তার আটকের বিষয়টি আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কেউ এখনও স্বীকার করেনি।জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে হামলার নেপথ্যের কারিগরদের একজন বাইক হাসান। এর আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলার নেতৃত্ব দেয় সে। রংপুরে খুনের শিকার জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি, ঝিনাইদহে শিক্ষক রতন কুমার, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীসহ বিভিন্ন হামলায় সে অংশ নেয়। বাইক হাসান জেএমবির একজন সংগঠক হিসেবে কাজ করে। কোথায় হামলা হবে, কোন হামলায় কে জড়িত থাকবে এর সবকিছুই সে পরিকল্পনা করে থাকে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কথিত দুই বড় ভাইয়ের নির্দেশেই শোলাকিয়ায় হামলা করতে যায় উল্লিখিত জঙ্গি টিমের সদস্যরা। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামে শুধু একজনের নাম জানা সম্ভব হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. দিদার আহাম্মদ বলেন, বাইক হাসান এ সময়ের শীর্ষস্থানীয় একজন জঙ্গি। আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে নজরদারির আওতায় নিয়েছে। তিনি বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আরও তথ্য উদ্ধারের স্বার্থে এখনই সবকিছু খোলাসা করা হচ্ছে না। তবে দ্রুতই অনেক তথ্য জানা যাবে।এদিকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলা করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়া জঙ্গি শফিউল ইসলাম গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে, বর্তমানে জেএমবি যত হামলা চালাচ্ছে এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে বেশ কয়েকজন জঙ্গি। সে সবার নাম জানে না। তবে তাদের কাছে ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচত জাহাঙ্গীর সবার নাম জানে। এ জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে কয়েকটি গ্র“পকে চালাচ্ছে বাইক হাসান নামে অপর এক জঙ্গি নেতা। তার দলে রয়েছে রিয়াজুল ও গোলাম রাব্বানী। এরা যে কোনো হামলার আগে ঘটনাস্থল রেকি করে থাকে।

গ্রেফতার জঙ্গি শফিউলের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিষয়েও পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। সে জানায়, জাহাঙ্গীরের হাতে বড় ধরনের অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র উত্তরাঞ্চলের কোনো চর এলাকায় মজুদ থাকতে পারে। এই জাহাঙ্গীরই তাদের গাইবান্ধায় গোবিন্দগঞ্জের বাসা ভাড়া করে দেয়। তাদের আরেকটি আস্তানা ছিল জামালপুরে। এখানে তাদের সবার যাতায়াত ছিল। এ দুটি বাসায় একাধিকবার আসে বাইক হাসানও। এ দলে ছিল খালেক নামে আরেক জঙ্গি। তাকে সবাই ‘মামা খালেক’ বলে ডাকে। রয়েছে ‘বিজয়’ নামে আরও এক যুবক। এরা সবাই অস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষিত। যমুনা নদীর চরে তাদের সবাইকে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরাও এ অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ওই প্রশিক্ষণে সেও ছিল। জুনের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বড় ধরনের হামলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। গুলশানে হামলাকারী পাঁচজন ২৭ জুন ঢাকায় আসে। এরপর ১ জুলাই তারা হামলায় অংশ নেয়। এরপরই শফিউল ও আবীরসহ চারজন ৩ জুলাই শোলাকিয়ায় যায়।শফিউল আরও স্বীকার করেছে, সে বাইক হাসানের টিমের একজন সক্রিয় সদস্য ছিল। এ বাইক হাসান সারা দেশে হামলাগুলোর পরিকল্পনাকারীদেরও একজন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সে হামলা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। আর বেশিরভাগ সময় সে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। খুব দ্রুত সে মোটরসাইকেল চালাতে পারে। এজন্য তার নামের পাশে ‘বাইক শব্দটি লাগানো হয়েছে। আর এ নামে তাকে সবাই চেনে। তার হাতে আরও বিভিন্ন স্থানে হামলার ছক রয়েছে।এছাড়া আরও যারা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের মধ্যে রিয়াজুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফরকেরহাটে। সাদ্দাম ওরফে চঞ্চল ওরফে রাহুলের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাটের বিদ্যানন্দেরচরে। একই এলাকায় গোলাম রাব্বানীরও বাড়ি। বিজয়ের বাড়ি বগুড়ায়। মামা খালেকের আসল বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কিন্তু পরে সে দিনাজপুরে থাকা শুরু করে। শফিউল ইসলামের কাছ থেকে এসব জঙ্গির বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।

গত বছর মার্চে কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় শফিউল ওরফে ডন। নিষিদ্ধ জেএমবির তরুণ নেতা কলেজছাত্র হাসান ফিরোজ ওরফে রসায়ন ফিরোজ তার জবানবন্দিতেও ডনের নাম জানায়। তার জবানবন্দিতে ডন ছাড়াও নাম উঠে এসেছে জাহাঙ্গীর, সাকিব মাস্টার, সাদ্দামসহ আরও কয়েকজনের।শফিউল স্বীকার করেছে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে বিদেশী নাগরিক, মুসলিম ছাড়া ভিন্ন ধর্মের লোকজন। বিশেষ করে ধর্মীয় পুরোহিত। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে তারা সমাজের হাইপ্রোফাইল লোকদের টার্গেট করে বড় ধরনের হামলা চালাবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম নষ্ট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। সে জানায়, প্রত্যেক জঙ্গিই দীর্ঘদিন ধরেই বাইরে আছে। অনেকের পরিবার তাদের সন্তানদের জঙ্গি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানে। কিন্তু তারা সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে মুখ খুলছে না। ‘কথিত হিজরতের’ নামে জঙ্গিরা প্রত্যেকে বাড়ি ত্যাগ করেছে। পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। এটিই তাদের প্রধান দীক্ষা। সে জানায়, জঙ্গি হিসেবে কামিয়াব হতে হলে তাদের ঘর-সংসার ত্যাগসহ বড় ধরনের হামলা চালাতে হবে। এ ছাড়া যখন তারা জঙ্গি হামলার জন্য নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে ঘোষণা দেয় তখন তাদের চোখের সামনে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।

প্রাথমিক তথ্যে সে আরও স্বীকার করেছে, নতুন করে যারা হামলায় অংশ নিচ্ছে এদের সবাই প্রশিক্ষিত। বিশেষ করে এরা সবাই পরীক্ষায় পাস করেছে। জঙ্গিদের ভাষায় যারা হামলায় অংশ নেবে তাদের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নেয়া হয়। আবার অনেকে হামলা করবে না বলে কান্নাকাটি করে। তারা পালিয়ে আসার চেষ্টা করে। এ রকম কয়েকজন জঙ্গির কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পেয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী। এদের মধ্যে রয়েছে- মুরাদ, ফরিদ ও তাহমিদ। যাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শফিউলের তথ্য অনুযায়ী জঙ্গিদের ঢাকায় একাধিক আস্তানা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা ও বাড্ডা অন্যতম।এ ঘটনায় রোববার বিকালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়। ঘটনার সময় শোলাকিয়া ঈদগাহ এলাকায় দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শামছুদ্দিন মামলাটি করেন। মামলায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজার এলাকার আবদুল হাই প্রধানের ছেলে জঙ্গি শরিফুল ও কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশা এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক (আটক) ও অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুর্শেদ জামান, এদের মধ্যে জাহিদুলকে একইদিন আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে আবেদন মঞ্জুর করা হয়।জানা যায়, ঈদের কয়েকদিন আগে ছাত্র পরিচয়ে শহরের নীলগঞ্জ রোডের পরশমণি নামের একটি আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ ২ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে ভাড়া নেয় জঙ্গিদল। পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ওই কক্ষটি পরিদর্শন শেষে সিলগালা করে দিয়েছে।বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী নিখোঁজ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি একেএম শহীদুল হক শনিবার বলেন,‘নিখোঁজদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত ও তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখা থেকে জঙ্গি কর্মকান্ডের বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। এর দায়িত্বে থাকা এআইজি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সারা দেশে কত সংখ্যক তরুণ-যুবক নিখোঁজ আছে আমরা তার একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।’ পুলিশ সদর দফতরের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৭৭ জন নিখোঁজ থাকা এবং ৫০টিরও বেশি নিখোঁজের জিডি হওয়ার প্রাথমিক তথ্য তারা পেয়েছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়বে।এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার জানান, তার এলাকায় যতগুলো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে সবগুলোতে তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। থানা পুলিশ এবং বিশ্বস্ত গুপ্তচরের মাধ্যমেও কারা কারা নিখোঁজ আছেন সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।ডিএমপি সদর দফতরের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ২৩ যুবক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন থানায় জিডি হয়েছে। তাদের সম্পর্কে ডিএমপিকে বিস্তারিত জানাতে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে এসব নিখোঁজ তালিকার মধ্যে কোনো উচ্চশিক্ষিত তরুণ রয়েছে কিনা তা আগেভাগে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) একজন কর্মকর্তা জানান, ‘এসবির সব জনবলের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তারা প্রতিটি মহল্লা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্নভাবে নিখোঁজদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ঈদের ছুটি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় তাদের তথ্য পেতে সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান এসবির ওই কর্মকর্তা।

দু’দিন আগে ১০ নিখোঁজ তরুণের বিষয়ে তথ্য চেয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে পুলিশ। তোমরা দেশের জন্য, ইসলামের জন্য, তোমাদের পরিবারের জন্য ফিরে এসো’ শীর্ষক ওই ভিডিও বার্তায় যাদের ছবি, নাম ও পাসপের্ট নম্বর দেয়া হয়েছে তারা হচ্ছেন- রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান, বাড্ডা এলাকার জুনায়েদ খান (পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), ঢাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম (পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫), ঢাকার ইব্রাহীম হাসান খান (পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), ধানমন্ডি এলাকার জুবায়েদুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর-ই ১০৪৭৭১৯), চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ আনসারী, সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরী (পাসপোর্ট নম্বর-এল ০৬৩৩৪৭৮), লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন (পাসপোর্ট নম্বর-এফ ০৫৮৫৫৬৮), সিলেটের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি (পাসপোর্ট নম্বর-টিকে ৮০৯৯৮৬০) ও জুনুন শিকদার (পাসপোর্ট নম্বর-বিই ০৯৪৯১৭২)।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ আশরাফ রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসে বসবাসরত সাবেক এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার মেধাবী সন্তান। বাসা থেকে যাওয়ার আগে বাবার উদ্দেশে সে একটি চিরকুটে লিখে গেছে। তাতে লেখা আছে, ‘আমি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছি।’ ৬ মাসের বেশি সময় পার হলেও আশরাফ মোহাম্মদের কোনো খোঁজ মেলেনি। ঢাকার ইব্রাহিম হাসান খান ফেসবুকে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই কোরআনের আয়াত দিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ জুন কয়েক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। তার যে ছবি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে রয়েছে সেটি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে থাকা ছবি। সেটি তার কিশোর বয়সের ছবি। ইব্রাহিম স্কুলজীবনে সৌদি আরবে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ালেখা করেন। তার চালচলন এবং জীবনযাপন দেখে উগ্রপন্থী হিসেবে জড়িত হওয়ার কোনো সন্দেহ করার সুযোগ ছিল না বলে তার এক বন্ধু জানান।

সিলেটের জুন্নুন সিকদার ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার হন। পরে জামিনে বেরিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। এরপর থেকে নিখোঁজ। অপরজন সাইফুল্লাহ ওজাকি জাপান থেকে সিরিয়ায় যান। লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন এক বছর আগে তিন সহযোগীসহ অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এরপর থেকে নিখোঁজ। সিলেটের তামিম আহম্মেদ চৌধুরী ছিলেন কানাডা প্রবাসী। সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে নিখোঁজ হন।

৫ জুলাই সিরিয়ায় আইএসের কথিত রাজধানী রাকা থেকে ‘হুমকি বার্তা’ সংবলিত একটি ভিডিওতে তিন বাংলাদেশী তরুণকে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর তিন তরুণের দু’জনকে চেনা সম্ভব হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকে তাদের মন্তব্যে লিখেছেন, এদের একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শফিউর রহমানের ছেলে তাহমিদ রহমান শফি। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ক্লোজআপ ওয়ানের তারকা হিসেবে খ্যাত। তার সঙ্গে অপর একজনের নাম তৌসিফ হাসান বলেও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।

এদিকে তাহমিদের বাবার বাসা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায়। বাড়িটির নকশা বাংলো ধরনের। দেখেই বোঝা যায় অত্যন্ত ধনী ও প্রভাবশালী মানুষ তারা। বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে ওই বাসাতেই থাকতেন সাবেক গ্রামীণফোনের এই কর্মকর্তা। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেছে, ফটক বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর দারোয়ান এসে কোনো কথাই বলতে চাননি। ভিডিও থেকে নেয়া তাহমিদের চেহারার একটি স্ক্রিনশটের প্রিন্ট আউট দেখানো হয় দারোয়ানকে। এরপর তিনি ভেতরে চলে যান। আর ফিরে আসেনি। বাড়িতে তাহমিদের মা এবং অপর দুই ভাই তাদের পরিবার-পরিজন থাকেন। তার বাবা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটে। গলির একজন চা দোকানি জানান, তার দোকানে তাহমিদ দুয়েকবার চা পান করেছে। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যেত। কিন্তু সাত-আট মাসের বেশি সময় ধরে দেখা যায় না। নাম প্রকাশ না করে বাড়ির এক বাসিন্দা জানান, তিনি শুনেছেন ওই বাড়ির এক ছেলে গ্রামীণফোনে চাকরি করত, যে বছরখানেক আগে বিয়ে করার পর স্ত্রীকে নিয়ে তুরস্কে চলে গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে তাহমিদ তুরস্ক হয়ে সিরিয়া ও ইরাকে গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে। আর তুরস্ক সিরিয়া ও ইরাকের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। তাহমিদ ধার্মিক ছিল। গ্রামীণফোনের বেশ কয়েকজন কর্মী জানান, তিন-চার মাস আগে সে ওই প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশন্স বিভাগে চাকরি করত।

এক বন্ধু জানান, এনটিভির ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ নামক রিয়েলিটি শোতে সে প্রায় প্রথম হয়ে যাচ্ছিল। সে মেধাবী শিল্পী। সে গান লিখত এবং সুর করত। ক্লোজআপ ওয়ানের প্রথম মৌসুমে সেরা পনেরো জনের তালিকায় ছিলেন তাহমিদ। বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত সঙ্গীত শিল্পী নাম প্রকাশ করে জানান, কয়েক বছর ধরে তাহমিদকে কোনো অনুষ্ঠানে গান করতে দেখেননি। কোনো অ্যালবামও করেননি। জানা গেছে, তাহমিদ ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ইংরেজিতে দক্ষ। আইএসের ভিডিওতে তাকে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।

ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, গত বছরের জুন মাসে রাজধানীর পল্লবী থেকে ফাইয়াজ ইশমাম নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল। ইশমাম উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এসএসসি পাস করার পর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি অনলাইন ইসলামী ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করছিলেন। তিনি আইএসে যোগ দেয়ার জন্য অপর আইএস সদস্য ফিদা ও গালিবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং অপর বন্ধুদের আইএসে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

ডিবি পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখা সূত্র জানায়, গত বছরের ২৪ মে আইএসের বাংলাদেশের কথিত প্রধান সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম বেগ ও তার সহযোগী সাবিক বিন কামালকে গ্রেফতার করা হয়। আমিনুল বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি মোবাইল ফোন কোম্পানির উচ্চপদে চাকরি করার পর সর্বশেষ কোকাকোলায় আইটি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। তার সহযোগী সাকিব একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে লালমাটিয়ার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমিনুল ইসলাম বেগ কমপক্ষে ৩ জনকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় আইএসে পাঠিয়েছেন। আমিনুল বেগ ওই সময় জানান, পূর্ব এশিয়ায় জাপান প্রবাসী এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নওমুসলিম তাকে আইএসে যোগ দিতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তার গ্র“পে আতিক সরকার, সিফাত, আবদুল্লাহ ও জাবেদ কায়সারসহ আরও ২০ জন ছিল। ডিবি তাদের সবার নাম প্রকাশ করেনি।

১৪ মার্চ র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মোবাইলে একটি এসএমএস আসে। ওই এসএমএস থেকে জানা যায়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। উধাও হওয়ার আগে সে মাকে টেলিফোন করে বলেছে, ‘মা আমি ইসলামের পথে চলে যাচ্ছি। আমাকে মাফ করো তুমি। তোমার সঙ্গে জান্নাতে দেখা হবে।’ বিষয়টি র‌্যাবকে জানানো হয়। র‌্যাব অনুসন্ধান করে জানতে পারে, ওই শিক্ষার্থী ধনাঢ্য এক পরিবারের সন্তান। তার বাবা একটি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কিন্তু তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

৮ ডিসেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে আইএসের কথিত পৃষ্ঠপোষক আবুল হাসানাতসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তাদের মধ্যে আরও ছিলেন নাহিদউদ্দোজা, নাহিদুল ইসলাম ও তাজুল ইসলাম। তাদের কাছ থেকে ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। আবুল হাসানাতের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাকুড়চিয়া মুন্সিবাড়ী গ্রামে। অপর যুবক নাহিদউদ্দোজার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেব গ্রামে এবং নাহিদুল ইসলামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সেয়দবাড়ি গ্রামে এবং তাজুল ইসলামের বাড়ি খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার হাজি ইসমাইল রোড এলাকায়। জিজ্ঞাসাবাদে আবুল হাসানাত জানান, তার ছেলে সাইফুল হক (সুজন) আইএসে যোগ দিয়েছে। সে সিরিয়ায় অবস্থান করছেন। তার আরেক ছেলে আতাউল হক (সবুজ) বিদেশে আছেন। তিনি জঙ্গি অর্থায়নের জন্য দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। উদ্ধার হওয়া ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা আতাউল হকের পাঠানো। সবুজও আইএসের হয়ে কাজ করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সামিয়ূন নামে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক আইএসের জন্য কর্মী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিল। তার উৎসাহে ওই বছরে ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমানসহ কয়েকজন সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেন। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আশেকুরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও সফলতা পাওয়া যায়নি। ওই বছরই আগস্টে ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, পাঁচজন ‘বাংলাদেশী’ যুবক আইএসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির কাছে জিহাদের শপথ নিয়েছে।সিটির ওই কর্মকর্তা আরও জানান, শুধু তরুণরাই নয়, তরুণীরাও আইএসের দিকে ঝুঁকছে। গত বছর বাংলাদেশী তরুণী মাইরুনা ফারহিন আইএসে যোগ দেয়ার উদ্দেশে ঢাকা থেকে তুরস্কে যান। তিনি তুরস্কে পৌঁছার পর বাংলাদেশ দূতাবাস জরুরিভিত্তিতে কূটনৈতিক নোট ভারবালের মাধ্যমে বিষয়টি তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। তুরস্কের ন্যাশনাল পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট মাইরুনা ফারহিনকে শনাক্ত করে এবং তুরস্কে প্রবেশের অনুমতি দেয়া থেকে বিরত থাকে। পরে গত বছরের ৫ মে তাকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। আরও কয়েকজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণী আইএসে যোগ দিয়েছে।নিখোঁজদের বিষয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, কোনো পরিবারের সন্তান নিখোঁজ হয়ে থাকলে তা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে। যারা নিখোঁজ আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ব্লগ-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা কোনো এলাকায় জঙ্গি তৎপরতার কথা জানা থাকলে সেটাও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি ।