রোববার চূড়ান্ত হচ্ছে বিএনপির পর্যবেক্ষণ কমিটি

দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা ইস্যুতে কঠোর কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। নরম কর্মসূচিতেই দলীয় প্রতিক্রিয়া জানালো তারা।

অর্থপাচার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আবারো নানামুখি চাপে পড়তে যাচ্ছে দলটি। কিন্তু তা সত্বেও এখনই সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে রাজি নয় বিএনপি । কারণ কঠোর কর্মসূচি নিয়ে সংঘাতে জড়ালে সরকার আবারো হামলা মামলা দিয়ে বিএনপিকে ঘায়েল করার সুয়োগ পাবে বলে মনে করেন দলের নীতি নির্ধারকরা।তাদের মতে নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে যেতে হয় এমন কঠোর কর্মসূীচি না দিয়ে আপাতত পরিস্থিতি সৃস্টি না করাই ভাল।

জাতীয় কাউনিস্ল শেষ হওয়ার পর এখনো দল গোছানো পুরোপুরি শেষ হয়নি।এছাড়া দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যেও ডাক দিয়েছেন ঐ প্রস্তাবটিও এখনো সামনে আছে। ফলে দল গোছানো এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপরই আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছে বেশী বিএনপি। এ দুটি ইস্যুও বাইওে দলটি আপাতত বড় ধরনের কোন আন্দোলনে যাবে না। বিএনপির নীতি নির্ধারণী এমন কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। দলের দ্বায়িত্বশীল সূত্র নেতারা বলছেন, সরকারের উসকানিতে পা দিবে না বিএনপি । বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় তারেক রহমানের সাত বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নিম্ন আদালতে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরও উচ্চ আদালতে এ মামলায় সর্বচ্চো সাজায় বৈঠকে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়।

উপস্থিত নেতারা একটা বিষয়ে একমত হন, অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারেন, সেই জন্য বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে।মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতে রিভিউ পিটিশন করার সিদ্ধান্ত হয় আজকের বৈঠকে। আইনি লড়াইয়ের বিভিন্ন দিক নিয়েও আলোচনা হয়।

সূত্র মতে, কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে দলের কয়েকজন নেতা কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানানোর পক্ষে মত দেন। তাদের যুক্তি ছিল-বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে সাজা দেওয়ার বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নিলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করবে। অন্তত একদিনের কঠোর কর্মসূচি দিয়ে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানানো উচিৎ।কিন্তু দলের চেয়ারপারসন ও শীর্ষ নেতারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিএনপির এই নাজেহাল অবস্থার মধ্যে কঠোর কর্মসূচির পরামর্শ প্রত্যাখান করেন। তাছাড় এখনো জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী কোনো কর্মসূচি দিতে না পাড়ায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইস্যুতে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়টি নৈতিকভাবে ঠিক মনে করেননি শীর্ষ নেতারা।

সূত্র মতে, সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহামনের আইনজীবীরা মামলার লিগ্যাল দিকগুলো তুলে ধরবেন। এর আগে সিনিয়র নেতারা আরেক দফা বৈঠকও সেরে নিতে পারেন।বৃহস্পতিবার রাতের বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। গতানুগতিক কর্মসূচিতে থাকছে। শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে। সংবাদ সম্মেলনে মূলত, মামলার লিগ্যাল দিকগুলো তুলে ধরা হবে।

এদিকে, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রমানের সাজার প্রতিবাদে শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করবে বিএনপি।শুক্রবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।তিনি বলেন, তারেক রহমান ন্যায় বিচার পাননি। দুদকের করা মানি লন্ডারিং মামলায় নিম্ন আদালত বেকসুর খালাস দিলেও উচ্চ আদালত তাকে সাজা দিয়েছে।

রিজভী জানান, বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতের রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুসহ সারা দেশে ২২ জন গ্রেফতার হয়েছেন।তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করবে বিএনপি। ঢাকায় সমাবেশের স্থান ও সময় পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। অর্থ পাচার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান দেশে ফিরলে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। শুক্রবার নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, তারেকের অনুপস্থিতিতে এক তরফাভাবে রায় দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় তার পক্ষে কোনো আইনজীবী কথা বলতে পারেন নি। এখন তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। যেদিন তিনি বাংলাদেশে ফিরবেন, সেদিন আমরা আপিল করব। আমরা আশাবাদী,আপিল করলে এই সাজা টিকবে না। বাংলাদেশের মানুষ জানবে, তারেক রহমানকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে।

তারেক রহমানকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে গাজীপুরের টঙ্গিতে একটি বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের সময় হারবিন পাওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং তাদের বাংলাদেশি এজেন্ট নির্মাণ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে কনসালটেন্সি ফি বাবদ সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে। এই অর্থ সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেন-দেন হয়।এই লেন-দেনের সঙ্গে তারেক রহমানের বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে তিনি বলেন, যে অর্থ লেন-দেন হয়েছে সেটি দেশের বাইরে হয়েছে। এটি চায়না হারবিন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি তাদের বাংলাদেশি এজেন্ট নির্মাণ ইন্টারন্যাশনাল মাধ্যমে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে দিয়েছেন। বিষয়টি দুদকের স্বাক্ষী হিসেবে নির্মাণ ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী খাদিজা ইসলাম আদালতে লিখিত স্বাক্ষ্য দিয়েছেন।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তারেক রহমানকে ফাঁসানোর জন্যই এই রায় দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যখন কোনো জাতীয় ইস্যু সামনে আসে, ঠিক তখনই চমক সৃষ্টির জন্য সরকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একেকটা ব্যবস্থা নেয়।ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, কনসালটেন্সি ফি বাবদ গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে চায়না কোম্পানি যে টাকা দিয়েছিল, সেখান থেকে সাপ্লিমেন্টারি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে তারেক রহমান মাত্র ১৯ লাখ টাকা খরচ করেছেন। সে টাকা পরবর্তী সময় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে ফেরতও দিয়েছেন তিনি। তাহলে মানি লন্ডারিং করলেন কীভাবে?

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আ স ম হান্নান শাহ, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউছুফ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মুজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ।

এদিকে, অর্থপাচারের একটি মামলায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের সাজা দেয়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে দলটি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াপল্টনে রায়ের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় ওই এলাকা থেকে পুলিশ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে আটক করে। এই রায় নিয়ে রাতে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বৈঠক নিয়ে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি। বৈঠকে অংশ নেয়া নেতারাও কেউ মুখ খুলছেন না। শুক্রবার দলটির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে বৈঠক সূত্র জানায়, তারেক রহমানকে সাজা দিয়ে যে রায় দেয়া হয়েছে তার প্রতিবাদে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

বৈঠকে অংশ নেয়া বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশসহ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।অবশ্য আরেকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বৈঠকে হরতালের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা চলছে, তাছাড়া মানুষ বর্তমানে হরতাল কতটুকু গ্রহণ করবে বা হরতাল কর্মসূচি সফল করার জন্য বিএনপির সাংগঠনিক সক্ষমতা কতটুকু আছে এসব প্রশ্নও সামনে আসছে। আবার দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারির বিরুদ্ধে যে রায় হয়েছে তাতে দলের পক্ষ থেকে কঠোর এবং সতর্কতামূলক কর্মসূচিও তো থাকা উচিত। এ নিয়ে কিছুটা দোলাচলেও থাকলেও দলের একটি অংশ মনে করছে, এর প্রতিবাদে হরতাল দেয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকালে অর্থপাচার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাত বছরের কারাদ- এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তারেকের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছর কারাদ- বহাল রাখা হয়েছে। তবে তাকে বিচারিক আদালতের দেয়া ৪০ কোটি টাকা অর্থদ- কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে। যদি এই মামলায় বিচারিক আদালত তারেককে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ‘বিভিন্ন পন্থায়’ ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের অ্যাকাউন্টে পাচার করা হয়, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন তারেক রহমান।