কারো ট্রেড লাইসেন্স থাকলেই তাকে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে’ এ নির্দেশনার কারনে বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এ কারনে তারা অযথা হয়রানীর শিকার হবেন। আর এ কারনে স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয়ার প্রবনতা কমে যাবে এবং স্থানীয় সরকারের এ বাবদ আয়ও কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের নারী উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন। সমস্যা সমাধানে যারা আয়করের আওতায় পড়েন না তাদের আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক না করার দাবী উঠেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এ বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ট্রেড লাইসেন্সধারি ব্যবসায়ী হলে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। কোনো সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সধারি ব্যবসায়ী অথবা কোনো সরকারি, আধা সরকারি বা স্থানীয় সরকারের কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহনকারি হলে মোট আয় যা-ই হোকে না কেন এ বছর (২০১৬-২০১৭ কর বছর) আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এ বছর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর। এ সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা ও বিলম্ব সুদ আরোপ করা হবে। বিজ্ঞাপনে আরো উল্লেখ করা হয়, এছাড়া রিটার্ন দাখিলে ব্যার্থ হলে কর আইন ভঙ্গ হবে। এতে এক বছর পর্যন্ত জেল অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয় শাস্তির বিধান রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জের বড়ালু গ্রামের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা কাকলীরো নজরে পড়েছে এ বিজ্ঞাপন। তার মাধ্যমে এ গ্রামের নব্বইটি পরিবারের নব্বইজন মহিলা ওড়নার কাজ করে আয় করছেন। কাকলী বললেন, আমি একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি। আমার সাথের আরো কয়েকজন নিয়েছে। যাদের অনেকেরই মাসিক আয় ৫ বা দশ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে তারা কোনরকমে চলেন। বছরে ট্রেড লাইসেন্সটা হয়তো কোন রকমে করবেন । কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স থাকলেই যদি আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয় তাহলে তাহলে তাদের কোনো আইনজীবির কাছে যেতে হবে। কোনো আইনজীবি কি দেড় হাজার টাকার নিচে কাজটা করে দেবেন ? যার মাসিক আয় দশ হাজার তার জন্য আইনজীবির এ খরচ বিশাল বোঝা। এ ছাড়া রয়েছে কাগজপত্র তৈরী করার ঝামেলা। এসব ঝামেলা এড়াতে আমাদের মতো গ্রামের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা রিটার্ন জমা দেবেন না। এবং ট্রেড লাইসেন্স নিতেও উৎসাহ হাড়িয়ে ফেলবেন। কাকলীর কথার প্রতিধ্বনী করলেন জনসংখ্যার দিক দিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ ইউনিয়ন পরিষদ কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু। তিনি বলেন, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়াটা কতটা ঝামেলা আর হয়রানীর বিষয় এটা যারা দেয় তারা জানে। এলাকার ছোট মুদি দোকানদার, ওষুধের ফার্মেসী, লন্ড্রী এমন ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকও ট্রেড লাইসেন্স নেয় আমাদের জনসংযোগ কার্যক্রমের কারনে। এটা বছরে একবার জমা দিতে হয়। হয়রানীর ব্যাপার নেই, টাকা নির্দিষ্ট করা থাকে এ কারনে। কিন্তু তাদের সবাইকে যদি আয়কর রিটার্ন দিতে বাধ্য করা হয় তাহলে অনেকেই হয়তো ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করবে না। এতে আমাদের তথা সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে।
ব্রাকের নারায়ণগঞ্জ অফিসের সিনিয়র সেক্টর স্পেশালিষ্ট গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তারা পিছিয়ে। ব্রাক তার ইইপি প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষন দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে। এরকম উদ্যোক্তা তৈরীর কাজ আরো অনেকেই হয়তো করছে। আমরা উদ্যোক্তা নারীদের ট্রেড লাইসেন্স করাচ্ছি। তাদের উইমেন চেম্বারের সদস্য করিয়েছে। কিন্তু এ পর্যায়ে তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের জটিল প্রক্রিয়ায় জড়াতে বাধ্য করলে তারা নিরুৎসাহিত হবে। তাই যারা করের আওতায় পড়েন না তাদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করার নির্দেশনাটি বাতিল করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বিষয়টিকে ভুল নীতি বলে আখ্যায়িত করেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবি এডভোকেট বাবুল চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের পুরো কর আদায় প্রক্রিয়াটি অসংখ্য ভুল নীতিতে ভরা। এটিও তেমন একটি ভুল নীতি বা নির্দেশনা। এটি পরিবর্তন করা উচিৎ। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের কর কমিশনার রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আপনার কাছ থেকে পাওয়া এই প্রতিক্রিয়াটি আমি উর্ধ্বতন কতৃপক্ষুকে জানাবো। তবে আমি আশ্বাস দিচ্ছি নারায়ণগঞ্জে কেউ কর দিতে এসে কোনো হয়রানীর শিকার হবেন না। আগামী ১লা নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শহীদ জিয়া হলে কর মেলায় নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আলাদা ডেস্ক থাকবে। আমি সেখানে এসে সকল নারী উদ্যোক্তাকে তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে বলবো। আমরাই তার ফরম পূরন করে দেবো। তাদের সহায়তা করবো। তাদের হয়রানী হতে হবে না।