%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%80-%e0%a6%87%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%80-%e0%a6%b8

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে শরীয়তপুরের রাজাকার বাহিনীর সদস্য পলাতক যুদ্ধাপরাধী ইদ্রিস আলী সরদারকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে সোমবার রায় ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল।আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করে। এটি ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত ২৭ তম রায়।

এ মামলায় ৪৮৬পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া হয়।রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা চার অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে আসামি ইদ্রিস আলী সরদারের সাজা কার্যকর করতে হবে।চার অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগ ও দ্বিতীয় অভিযোগে ইদ্রিস আলীর মৃত্যুদন্ড, তৃতীয় অভিযোগে আমৃত্যু কারাদন্ড এবং চতুর্থ অভিযোগে তাকে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। আসামি ইদ্রিসকে গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ মামলায় কারাবন্দি অপর আসামি সোলায়মান মোল্লা গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ কারণে তার নাম মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়।প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এ আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে আপিল করা যায়। তবে পলাতক ইদ্রিসকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জানায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নের পালং থানার পশ্চিম কাশাভোগ গ্রামের ইদ্রিস আলী সরদার স্থানীয় রুদ্রকর নিনমনি হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। ওই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইদ্রিস ছাত্র সংঘের স্থানীয় নেতায় পরিণত হন। ছাত্রসংঘের অন্য অনেক নেতাকর্মীর মত তিনিও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গড়ে তোলা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন।শরীয়তপুর সদর উপজেলার স্বর্ণঘোষ গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার ২০১০ সালের ১১ মে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্লার বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের আদালতে মামলা করেন। ওই মামলা পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হয়। পরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হেলাল উদ্দিন অনুসন্ধান শেষে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। অন্যদিকে ইদ্রিসের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বলেছেন, তার মক্কেল আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করলে আপিলে খালাস পাবেন বলেই তার বিশ্বাস।এর আগে গত বছরের ১৪ জুন সোলায়মান ও ইদ্রিসের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ১৬ নভেম্বর প্রসিকিউশন দুই আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। গত বছর ২২ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। গত ২ মে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগে আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

মামলায় আনীত-প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে আসামিরা দখলদার পা হানাদারবাহিনীর ১০০ থেকে দেড়শ’ জন সদস্যসহ শরীয়তপুর জেলার পালং থানা এলাকায় কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কৃষক আব্দুস সামাদসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা ও বাড়ির মালামাল লুট করেন।দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৬ মে পালং থানার মালোপাড়া ও রুদ্রকর গ্রামে হামলা চালিয়ে মঠের পুরোহিতকে গুলে করে হত্যা ও গ্রামগুলো থেকে মামালাল লুট ও আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে আসামিরা। ওইদিন মালোপাড়া থেকে ৩০/৪৫ জন নারী ও পুরুষকে ধরে মাদারীপুর পাক হানাদার ক্যাম্পে নিয়ে তিনদিন আটকে রেখে নারীদের ধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়। পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়।তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৬ জুন একই থানার শৈলেন্দ্র কৃষ্ণ পালের বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুইজনকে হত্যা করে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতন করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিঁয়ে হত্যা করে আসামিরা।চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা দখলদার বাহিনীর সহায়তায় এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ করেন। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে পালং থানার এক থেকে দেড় হাজার মানুষকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তারা ভারতের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেন।

রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা চার অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে আসামি ইদ্রিস আলী সরদারের সাজা কার্যকর করতে হবে।চার অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে ২০০ জনকে হত্যা এবং দ্বিতীয় অভিযোগে বহু মানুষকে হত্যা, নারীদের নির্যাতনের ঘটনায় ইদ্রিস আলীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।আর তৃতীয় অভিযোগে চারজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার ঘটনায় তার আমৃত্যু কারাদ- এবং চতুর্থ অভিযোগে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় সাত বছরের কারাদ-ের রায় দিয়েছে আদালত।

আসামি ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে।এ মামলায় অভিযুক্ত অপর আসামি মাওলানা সোলায়মান মোল্যা ওরফে সোলায়মান মৌলভী গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ কারণে তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

মামলার অভিযোগপত্র্রে বলা হয়, দুই আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ইদ্রিস তখন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় নেতা। আর সোলায়মান প্রথমে মুসলিম লীগ ও পরে জামিয়াতুল উলামায় ই-ইসলামীর নেতা ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা যে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী কর্মকা- ঘটিয়েছিলেন, তা উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক ইদ্রিসকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ২৭টি মামলার ৪৬ আসামির মধ্যে মোট ২৮ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল।

পালং থানার কাশিপুর গ্রামের সোলায়মান মোল্যার জন্ম ১৯৩১ সালে। ১৯৬৩ সালে তিনি দাওরা পাস করে মুসলিম লীগে (ফজলুল কাদের) এ যোগ দেন। পরে তাকে পালং থানা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও করা হয়।অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামিয়াতুল উলামায় ই-ইসলামীতে যোগ দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন সোলায়মান।মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজের এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন এবং পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেন বলে অভিযোগপত্রের তথ্য।মামলা বৃত্তান্ত: শরীয়তপুর সদর উপজেলার স্বর্ণঘোষ গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার ২০১০ সালের ১১ মে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্যাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের আদালতে মামলা করেন। ওই মামলা পরে পাঠানো হয় ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত কর্মকর্তা মো.হেলাল অনুসন্ধান শেষে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। গতবছর ২২ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন রাখে।যুদ্ধাপরাধের চার ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চলতি বছর ২ মে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৩ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলেন না।প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আদালত গত ২ নভেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে।এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের সঙ্গে ঋষিকেশ সাহা ও রেজিয়া সুলতানা চমন শুনানিতে অংশ নেন। তারা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আরজি জানান।অন্যদিকে পলাতক ইদ্রিসের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসাবে শুনানি করেন গাজী এমএইচ তামিম।