বিচার বিভাগ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বিচারপতিদের কটাক্ষ করে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে সংসদ সদস্যরা নিজেদের করা আইনই ভঙ্গ করেছেন।মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংবিধান বিশ্লেষকেরা। এই গোলটেবিলের আয়োজন করে সুজন।সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কোন দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কর্তৃত্ববাদী সময়ে দেশের বিচার বিভাগ সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ভয়াবহ চিন্তা এখন জনগণের মধ্যেও ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।।উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের যে রায়ে বাতিল হয়েছে তা নিয়ে গত রবিবার জাতীয় সংসদে তীব্র সমালোচনা করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে প্রধান বিচারপতিসহ মতামত প্রদান করা অ্যামিকাস কিউরিদের নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করা হয়।
জাতীয় সংসদে আদালত নিয়ে এমন মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, অনেকে হয়তো বলতে সময় কি বলেছেন সেটা উপলব্ধি করেননি। আমি সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করব তারা ইউটিউব থেকে নামিয়ে নিজর বক্তব্যটা দেখবেন। তখন তারা উপলব্ধি করতে পারবেন কি বলেছেন। এসব বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে পার্লামেন্ট মেম্বাররা নিজেদের নিয়মকানুন ভঙ্গ করেছেন।বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ নীতিমালা তৈরি, অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে প্রদান ও বিচার বিভাগের জন্য বাজেট বৃদ্ধির পরামর্শও দেন এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ।তবে বিচার বিভাগেও সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিচার প্রশাসনেও গলদ আছে। এখানে সর্বময় ক্ষমতা পধান বিচারপতির। এটা সাংঘাতিক দুর্বল অবস্থা। যতোবিজ্ঞই হোন না কেন, প্রশাসনিক ক্ষমতা একক ব্যক্তির হাতে থাকলে সেখানে গলদ হতে বাধ্য। এটা পরিবর্তন করতে হবে।অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী এনে ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ শুধু বাজেট পাশ ও অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে। আর সংবিধানে আরেকটি সংশোধনী এনে যদি বিচারকদের অসদাচারণ ও অসামর্থ্যের তদন্তের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে যদি দেন তাহলে আমরা ষোড়শ সংশোধনী সমর্থন করব।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারের কারও এমন কথা বলা উচিত না যাতে এর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগেরও উচিত বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষা করা।বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্বাধীন দেশে সবাই আজ নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিরুদ্ধ মত পোষণকারীরা মনে করেন তারা কখন জানি আবার অপহরণ হয়ে যান। সাংবাদিক, এনজিওকর্মী এবং সাধারণ নাগরিক সবাই নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।তিনি আরও বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে আজ সংসদ সদস্যরা সরব। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন বাতিল করা হলো তখন তারা কেন সরব হলেন না? আসলে জনগণের প্রকৃত মেন্ডেট (সমর্থন) নিয়ে এলে যে আত্মবিশ্বাস থাকে টেকনিক্যালি মেন্ডেট নিলে সেটা থাকে না।অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম. হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, আমরা যখন বললাম বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত তখন মানহানির মামলা হলো। আমাকে ছয় মাস সেই মামলা নিয়ে চট্টগ্রামে দৌড়াতে হলো। এখন বিচার বিভাগ নিয়ে সংসদ সদস্যদের প্রশ্ন আসছে। সংসদ সদস্যদের আচরণবিধির জন্য সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী একটি প্রাইভেট মেম্বার বিল উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেই বিলটি পাশ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, নিম্নআদালতকে সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ক্ষমতায় আসার আগে সবাই মেনিফেস্টোতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে। কিন্তু ক্ষমতায় এলে তা ভুলে যায়। আসলে কোন সরকারই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় না।অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত লিখিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আমাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাউকে বলতে শোনা যায়, আইনসভার সদস্যগণ বহু খাটাখাটনি করে আইন প্রণয়ন করেন কিন্তু উচ্চ আদালতে দুজন বিচারক তাদের কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দেন। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের অভিমত ক্ষমতার পৃথকীকরণের নীতি সম্পর্কে ধারণার অস্পষ্টতারই প্রতিফলন। ক্ষমতার বিভাজনের নীতি অনুসরণে আমাদের সংবিধানে আইন প্রণয়নের, নির্বাহী বিভাগকে আইন প্রয়োগের এবং বিচার বিভাগকে বিচারিক পর্যালোচনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের বিচারিক ক্ষমতার মধ্যে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান অন্তর্ভুক্ত। তাই বিচারিক পর্যালোচনার এবং সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে উচ্চ আদালত সংসদে পাশ করা যেকোনো আইনকে অসাংবিধানিক বা বেআইনি ঘোষণা করতে পারেন। সংবিধান আদালতকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।লিখিত বক্তব্যে দক্ষ অ্যাটর্নি সার্ভিস বা সরকারি প্রসিকিউশনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এক সময় যে আইনজীবীরা নতুন সরকারি দলের পক্ষে চোঙ্গা-ফুকতেন’তারা সদর্পে আবির্ভূত হন পাবলিক প্রসিকিউটর বা সরকারি কৌশলী রূপে। এ ধরনের অদ্ভুত এবং ন্যায়বিচারের জন্য হয়রানিমূলক ব্যবস্থার অবশ্যই নিরসন করতে হবে।এছাড়া সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন, সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২ সালের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণ এবং বিচার বিভাগীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। গোলটেবিলের সঞ্চালক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ৫৩, ৬৩, ও ১৩৩ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যাবে না। এই বিধি সংসদপ্রণীত একটি আইন। সংসদ সদস্যরা নিজরাই তাঁদের করা এই আইন মানেন না। এটা দুঃখজনক।