কক্সাবাজারের উখিয়ায় সাগরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাবাহী নৌকা ডুবে নিহত ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার বিকালে জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানি সৈকতের পাতুয়ারটেক এলাকা লাশগুলো উদ্ধার করা হয় বলে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী জানান।নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু।এছাড়া এ সময় আরও চারজনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, বিকাল ৫টার দিকে পুলিশ ও স্থানীয়রা সাগর থেকে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। আরও লাশ ভাসতে দেখা যাচ্ছে।

মিয়ানমারের রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনা ক্যাম্পে গত ২৪ অগাস্ট রাতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ¯্রােত চলছে।রাখাইনে পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে পায়ে হেঁটে যারা বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছেন, তারা মংডু থেকে মাছ ধরার নৌকায় করে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। এ সময় নৌকা ডুবে মারা যাচ্ছে অনেক নারী ও শিশু।এদিকে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রও কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিয়োজিত দেশটির রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট।বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তার আওতায় ইতোমধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএফপি) আরও ৬০ লাখ ডলার দিয়েছে। এই তহবিল ডব্লিউএফপিকে এ বছরের শুরুতে দেওয়া ১০ লাখ ডলারের সঙ্গে যুক্ত হবে।

বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গা সংকটে ভুগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সংকট এখন আরও তীব্র হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট এবং সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।আলাপ-আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত এবং এ সংকটের সমাধান হবে বলে মনে করছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশেষ বিমানযোগে কক্সবাজার আসেন বার্নিকাট। এরপর বেলা ১টার দিকে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে যান।সেখানে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিবন্ধন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পরে ডব্লিউএফপি খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম এবং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।পরে তিনি বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শনে যান।এসময় তার সঙ্গে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং মার্কিন দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।বিকালে তিনি কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেনঅন্যদিকে, রাখাইন সফর করে আসা ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবে যথাসম্ভব ব্যবস্থা নিতে অং সান সুচির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।তিনি বলেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা দেয়ার আহ্বানে মিয়ানমারের নেত্রীকে সাড়া দিতে হবে।যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মার্ক ফিল্ড নেইপিদোতে সুচির সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমের ডিরেক্টর জেনারেল উইলিয়াম লেসি সুইং সেনা অভিযানে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন বলে জানান।যদিও মিয়ানমার বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।অপরদিকে, রাখাইনে চলমাস সহিসংতায় পুড়িয়ে দেয়া ভুমির দখল মিয়ানমার সরকার নেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আইয়ে।তিনি বলেন, দেশের আইন অনুযায়ী পুড়ে যাওয়া ভূমি সরকারের দখলে চলে যায়। সরকার এসব ভূমির পুনঃ উন্নয়ন করবে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার দিনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য ভারত ও চীনের সাড়ে সাতশ টন ত্রাণ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ভারত থেকে তৃতীয় চালানে ৭০০ টন ত্রাণ নিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস ঘড়িয়াল বৃহস্পতিবার ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১ নম্বর জেটিতে পৌঁছায়।আর চীন থেকে পাঠানো দ্বিতীয় চালানে সাড়ে ৫৩ টন ত্রাণ নিয়ে একটি উড়োজাহাজ সকালে ৯টার দিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামে।বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে তার সরকারের পাঠানো ত্রাণ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর, নৌবাহিনী, ভারতীয় নৌবাহিনী, চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশন ও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধতন কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ভারত থেকে তৃতীয় দফায় আসা এই ত্রাণের চালানে চাল, ডাল, লবণ, চিনি, চা, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, সাবান ও মশারি রয়েছে।মোট ৬২ হাজার প্যাকেটে এই ত্রাণ বিতরণের জন্য তৈরি করা হয়েছে বলে হাই কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ৫৩ টন এবং পরদিন আরও ১০৭ টন ভারতীয় ত্রাণ চট্টগ্রাম পৌঁছায়।রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত থেকে মোট সাত হাজার টন ত্রাণ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা এর আগে জানিয়েছিলেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।চীন থেকে বৃহস্পতিবার আসা দ্বিতীয় চালানে রয়েছে তিন হাজার কম্বল। বাংলাদেশে চীন দূতাবাসের ইকোনমিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল কাউন্সেলর লি গুয়াংজুন বিমানবন্দরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে এই ত্রাণ হস্তান্তর করেন।চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বুধবার একটি চীনা বিমানে ৫৭ দশমিক শূন্য তিন টন ত্রাণ এসেছিল। সেখানে ছিল ২২০০ তাঁবু। এসব ত্রাণ কক্সবাজারের উখিয়ায় পাঠানো হচ্ছে।চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং চিয়াং সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, শরণার্থীদের জন্য তার দেশ মোট ১৫০ টন জরুরি ত্রাণ চট্টগ্রামে পাঠাচ্ছে।মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে দমন-পীড়নের মুখে গত এক মাসে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।মিয়ানমারের মিত্র চীন ও ভারত রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমনে দেশটির সরকারকে সমর্থন দিলেও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থানে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ, রেডক্রস ও রেডক্রিস্টেন্টের দেওয়া মোট এক হাজার ৩০৩ টন ত্রাণ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে।এর মধ্যে ভারত দুটি বিমান ও একটি জাহাজে ৮০৭ টন, চীন দুটি বিমানে ১১০ দশমিক ৫৩ টন, সৌদি আরব একটি বিমানে ৯৪ টন, ইন্দোনেশিয়া আটটি বিমানে ৭৭ টন, ইরান দুটি বিমানে ৬৮ টন, মরক্কো একটি বিমানে ১৪ টন ও মালয়েশিয়া একটি বিমানে ১২ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে।এছাড়া মালয়েশিয়ার রেড ক্রিসেন্ট ১০১ দশমিক ৫ টন ও জাপানি রেডক্রস ১৮ দশমিক ৫ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশে।এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে এই আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছে ১৫ সদস্যের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সেখানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। বাংলাদেশও সেখানে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন।রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর এর আগে দুই দফায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিল নিরাপত্তা পরিষদ। গত সপ্তাহে রাখাইন পরিস্থিতির নিন্দা এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল।কূটনীতিকরা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ার বিষয়ে ভাববে নিরাপত্তা পরিষদ। তবে মিয়ানমারের মিত্র চীন ও রাশিয়া এ বিষয়ে জোরালো কোনো প্রস্তাব গ্রহণের বিরোধিতা করতে পারে।বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়া রয়েছে উল্টো অবস্থানে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমনের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে সমর্থন জানিয়ে আসছে তারা। নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস করতে ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে অন্তত নয় দেশের সমর্থনের পাশাপাশি পাঁচ স্থায়ী সদস্য চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অনাপত্তি দরকার হয়। বর্তমানে মিশর, ইতালি, জাপান, সুইডেন, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, সেনেগাল, ইউক্রেইন ও উরুগুয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য।