রোববার ভয়াল ১২ নভেম্বর।ভোলাসহ উপকূলবাসীর বিভিষীকাময় এক দুঃস্বপ্নের দিন। এক এক করে ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি স্বজন হারা মানুষের। ১৯৭০ সালের এই দিনে বিস্তীর্ন এলাকা ল-ভন্ড হয়ে ধ্বংস লীলায় পরিনত হয়। মুহুর্ত্বের মধ্যে প্রলংয়নকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলচ্ছাস ক্ষত বিক্ষত করে দেয় উপকূলীয় জনপথ। মৃত্যু পুরীতে পরিনত হয় দ্বীপ জেলা ভোলা। দূর্ণিঝড়ের হাত থেকে রক্ষাপেতে ছুটাছুটির আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হন উপকূলের বাসিন্দারা। ওই ঝড়ে ভোলায় নিহত হয় ২ লক্ষাধিক মানুষ। নিখোঁজ হয় সহস্রাধিক। আজও উপকূল বাসীকে কাঁদায় সে ঝড়ের বিভীষিকাময় স্মৃতি।

১৯৭০’র এর ১২ নভেম্বর। দিনভর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস। সন্ধ্যার পর মুহুর্তের মধ্যেই ভয়ানক রুপ ধারণ করে। গভীর রাতে শুরু হয় ঝড়ের তা-ব। হারিকেনরুপী জলোচ্ছাসের সময় ঝড়টি উপকূলীয় জেলা ভোলা, নোয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ ১৮ টি জেলায় আঘাত হানে। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সব চেয়ে বেশি ক্ষয় ক্ষতি ও মৃত্যু পুরীতে হয় দ্বীপ জেলা ভোলা। তৎকালীন সময় তথ্যপ্রযুক্তি দুর্বল থাকায় উপকূলে অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বভাস পায়নি। এসময় জলচ্ছাস হয়েছিল ৮/১০ ফুট উচ্চতায়।

কেউ গাছের ডালে, কেউ উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ১০দিন পর্যান্ত তাদের না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। বেঁড়ীবাধ, জলাভূমিসহ বিভিন্ন প্রান্তে স্বজন হারা মানুষগুলো তাদের প্রিয়জনের লাশ খুঁজে বেড়িয়েছে। ৪৭ বছর আগের এই দিনে এক রাতের ব্যবধানে ভোলার চার ভাগের একভাগ মানুষ নিমিষে নিঃশেষ হয়ে যায়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় এখানকার বিস্তীর্ণ জনপদ। সাগর পাড়ের মনপুরা, কুকরী-মুকরী ঢালচরসহ ছোট ছোট দ্বীপচর এবং নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বেশিরভাগ মানুষই প্রাণ হারায়। এমনকি ভোলা শহরও গোর্কির ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। গোটা এলাকা পরিণত হয় মানুষ আর গবাদিপশু’র লাশের স্তুপে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিলো যে, মা তার প্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সত্তরের সেই যন্ত্রণাময় স্মৃতি নিয়ে এখনো দিন কাটছে তাদের।

ভোলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম হাবিবুর রহমান ভয়াল সে রাতের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লত হয়ে পড়েন, তিনি বলেন ঝড়ের পরে মেঘনা পাড়ে গিয়ে দেখেন ¯েœহ ময়ী মা তার শিশু সন্তানকে জড়িয়ে মরে পরে আছে। গাছে গাছে লাশ ঝুলছে। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সেদিনের সেই ঝড়ে বেঁচে আসা চরপাতা ইউনিয়নের বাসিন্দা নুরুল হক জানান, সন্ধ্যার পর থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এক পর্যায়ে দমকা হাওয়ায় পরিণত হয়। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। পানি প্রথমে ভিটায় পরে ঘরের চাল পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়। তিনি একটি গাছ ধরে কোন মতো জীবন রক্ষা পাণ। সেদিনের সেই ভয়াল মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে আসা শাহে আলম জানান, পরের দিন সকাল বেলা এত মানুষ আর গবাদি পশুর লাশ দেখতে পান তারা যা আলাদা আলাদা ভাবে কবর দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই মানুষ আর পশুকে এক সাথেই গর্ত করে পুতে রাখতে হয়েছে তাদের। সত্তরের পর ভোলার মানুষ একাধিকবার এমনিভাবে ঝড়-ঝঞ্জা আর জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়েছেন। তবে ভোলাবাসী সব ভুলে গেলেও গোর্কির কথা কোন ভাবেই ভুলতে পারছেন না। সত্তরের গোর্কির মতো ভোলাবাসিকে এমন নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের কবলে যেন আর পড়তে না হয়, এমনটাই প্রার্থনা দেশের মূলভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলার ২২ লাখ মানুষের। এদিকে, ৭০’র বন্যার পর সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু এবং নাধার মত ঝড় বয়ে গেলেও উপকূল বাসীর জন্য আজও পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভোলার সমগ্র উপকূলের মানুষ এখনও অনিরাপদ।