টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে লাখ লাখ ধর্মপ্রান মুসলমানের কন্ঠে আমিন আল্লাহুমা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হলো এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব। তাবলীগ জামাতের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম আরবী-ঊর্দুর সঙ্গে বাংলায় অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব এজতেমার আখেরি মোনাজাত। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ্ ভিক্ষা করছিলেন মুসুল্লীরা। ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনা করা হয় তাবলিগ জামাতের ৫৩তম বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতে। এরআগে হেদায়েতী বয়ান করা হয়। প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্বের এজতেমা হবে আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

বাংলাদেশের রাজধানীর কাকরাইল তাবলীগ মারকাজের বিশেষ ব্যক্তিত্ব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের ছোট ছোট বাক্যে আরবী-উর্দু ও বাংলা ভাষায় ৩৫ মিনিট ব্যাপী আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি বেলা ১০টা ৪০ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু করেন এবং তা চলে বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত। ৩৫ মিনিট ব্যাপী মোনাজাতের মধ্যে ১৪মিনিট আরবী ও ২১ মিনিট বাংলায় মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকা জুড়ে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। খানিক পর পর শুধু ভেসে আসে আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তাঁরা। ক্ষমা লাভের আশায় ধনী-গরীব-শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সর্বস্তরের লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে রবিবার। এবারের প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ১৮ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে সংশিষ্ট সূত্রের ধারণা।

এদিকে, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার ভোর রাত থেকেই টঙ্গীর এজতেমা অভিমুখে শুরু হয় মানুষের ঢল। টঙ্গীর পথে শনিবার মধ্যরাত থেকেই এজতেমা ময়দানগামী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মোনাজাতে অংশ নিতে চার দিক থেকে লাখ লাখ মুসুল্লী পায়ে হেঁটেই এজতেমাস্থলে পৌঁছেন। মোনাজাতের আগেই এজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হলে মুসুল্লীরা মাঠের আশে-পাশের রাস্তা,অলি-গলিতে অবস্থান নেন। এজতেমাস্থলে পৌঁছুতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামার পাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসুল্লীরা অবস্থান নেন। যে দিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মানুষ আর মানুষ। এজতেমাস্থলের চারপাশের ৩-৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশে-পাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন।

বাংলায় হলো আখেরি মোনাজাত ॥ তাবলীগ জামাতের প্রায় ৫৩ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম আরবী-ঊর্দুর সঙ্গে বাংলায় বিশ্ব এজতেমায় আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হলো। মোনাজাত পরিচালনাকারী বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়ের আগে বিশ্ব এজতেমায় ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভী কিংবা জোবায়রুল হাসানের বয়ান বাংলায় তরজমা করতেন। তাবলীগের আমির ভারতের মাওলানা জোবায়রুল হাসানের মৃত্যুর পর ২০১৫সাল থেকে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভী আরবি কিংবা উর্দুতে মোনাজাত পরিচালনা করতেন। নানা বিতর্কের কারনে মাওলানা সাদ এবারের বিশ্ব এজতেমায় যোগ দেননি। পরে আখেরি মোনাজাত পরিচালনার দায়িত্ব পরে মাওলানা জোবায়েরের উপর। মাওলানা জোবায়ের এবারই প্রথম আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করলেন।
বাংলা মোনাজাতে তুষ্ট মুসুল্লীরা ॥ নিজ মাতৃভাষা বাংলায় মোনাজাত পরিচালিত হওয়ায় বাংলাদেশের মুসুল্লীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নলজানী এলাকার বাসিন্দা এমরানূর রহমান এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ২৫বছর ধরে বিশ্ব এজতেমার মোনাজাতে অংশ নিচ্ছি। আমি উর্দু-আরবী বুঝি না। আগে ওইসব ভাষায় পরিচালিত মোনাজাতের কথা বুঝতে পারতাম না। অথচ আমাদের দেশে বিশ্ব এজতেমা হয়। আর আখেরি মোনাজাত হত ভিন ভাষায়। কখন মোনাজাত শুরু হত, কখন শেষ হত তা বুঝতেই পারতাম না। সকলের সঙ্গে শুধু আমিন, আল্লাহুমামিন বলতাম। এবার মোনাজাত বাংলায় হওয়ায় ওই সমস্যায় পরতে হয়নি কাউকে।

শেষ দিনে বয়ানকারী ॥ রবিবার আখেরী মোনাজাতের দিন বাদ ফজর থেকে খাস বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। এরপর মোনাজাত পরিচালনার আগে বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জোবায়ের তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে হেদায়তি বয়ান করেন। এসময় এজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান শুনেন। ভিআইপিদের মোনাজাতে অংশ গ্রহণ ॥ বিশ্ব এজতেমার মূল আকর্ষণ হচ্ছে আখেরি মোনাজাত। প্রতিবারের মতো এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে মন্ত্রী পরিষদের বিভিন্ন সদস্যবর্গ, সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাসহ বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ অংশ গ্রহণ করেছেন। তারা টেলিভিশনের সামনে বসে সরাসরি সম্প্রচার দেখে মোনাজাতে অংশ নেন। এদিকে বিশ্ব এজতেমায় আগত লাখো লাখো মুসল্লির সঙ্গে এজতেমা ময়দানে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির, পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান ও গাজীপুর মহানগর যুবলীগ আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও আখেরী মোনাজাতে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের কূটনীতিক বৃন্দ, বিভিন্ন রাজনেতিক দলের নেতৃবর্গ শরিক হন। এ ছাড়া পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দল-মত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন।

গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ॥ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ছিল। ফলে এবার এসব কারখানার শ্রমিকদের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি।

টেলিভিশন-মুঠোফোন ও ওয়্যারলেস সেটে মোনাজাত ॥ এজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর এজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে কনফারেন্সের মাধ্যমে গত কয়েকবারের মতো এবারও গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরী মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে কয়েক হাজার নারী পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী সড়কে ও ভবন গুলোতে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়াও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশন, ওয়্যালেস সেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়। এসব স্থানেও পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করার কারনে অনেকে বাসায় বসে মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। আবার দেশ বিদেশের বিভিন্ন অ ল থেকে অনেকে ইজতেমাস্থলে অবস্থানকারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেও মোনাজাতে শরীক হয়েছেন।

মোনাজাত শেষে যানজট ॥ মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে টঙ্গীর আশে-পাশের সড়ক-মহাসড়ক গুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে যানজটের বিড়ম্বনা এড়াতে অনেক মুসল্লী পায়ে হেটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আর পাঁয়ে হাঁটা মুসুল্লীদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসুল্লীদের যানবাহন রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থাকে এজতেমা মাঠের আশে-পাশের এলাকায়।

মুসল্লিদের জন্য ট্রেন ও শাটল বাস ॥ আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে এজতেমা ময়দানে যেতে ও মোনাজাত শেষে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ বাড়ি ফিরতে পারেন সেজন্য গাজীপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন শনিবার মধ্যরাত হতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে আব্দুল্লাহপুর এবং কালীগঞ্জ সড়কের মীরের বাজার হতে কামারপাড়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। তবে ওই এলাকায় মুসল্লীদের সুবিধার্থে ময়দানমুখী শাটল বাস চলাচল করেছে। আখেরী মোনাজাত শেষে মুসল্লিরা এ শাটল বাসে যাতায়ত করে। মোনাজাত শেষে টঙ্গী থেকে সবার বাড়ি ফেরার সুবিধার জন‌্য ১৯টি বিশেষ ট্রেনের ব‌্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ।

প্রথম পর্বে প্রায় তিনহাজার জামাত তৈরী ॥ বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, বিভিন্ন দেশে তাবলীগের কাজে বের হতে এবার এজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে প্রায় ৩ হাজার জামাত তৈরী হয়েছে। এরমধ্যে দেশীয় জামাত হয়েছে প্রায় দু’হাজার এবং প্রায় ৮শ’ বিদেশী জামাত হয়েছে। এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দু’চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও একবছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামি ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ॥ আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লীও আগের দিন রাত থেকে এজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন।