জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আগামী বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।আইনজীবীরা বলছেন, কাল বুধবার নিম্ন আদালতের রায়ের ‘সার্টিফায়েড কপি’ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী জানিয়েছেন, প্রথমে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করা হবে। এরপর জামিন আবেদন করা হবে। ওই আইনজীবীর মতে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন জামিন পাওয়ার যোগ্য।কেননা এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ কম। তাঁর সামাজিক অবস্থা, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তিনি। এ ছাড়া একজন নারী, তাঁর বয়স ও স্বাস্থ্যগত বিষয়টি জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের বিবেচনার বিষয় হবে। ফলে এ মামলায় জামিন পাওয়া নিয়ে তাঁরা চিন্তিত নন।ওই আইনজীবীর মতে, কয়েকটি মামলায় খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার চাচ্ছে না কেবল জিয়া অরফানেজ মামলায় খালেদা জিয়া জামিন পেয়ে বেরিয়ে যাক। রাষ্ট্রপক্ষ বিভিন্ন মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁর কারাবাস দীর্ঘ করতে পারে বলে তাঁর ধারণা।

এদিকে, মঙ্গলবার কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা বিশেষ জজ আদালত-৫-এ যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের বলা হয়েছে, বুধবার কপি পাওয়া যাবে। কপি পেলে তাঁরা বৃহস্পতিবার আপিল করবেন।জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া প্রায় ২ কোটি ১১ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এ মামলায় খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে ১০ বছরের জেল ও সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেছেন, রায়ের কপি পেলে তারা বুধবার আপিল জমা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছে আদালত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী পুরানো ঢাকার কারাগারে রাখা হয়েছে।তার সঙ্গে দেখা করার জন্য মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে সানাউল্লাহ মিয়াসহ চার আইনজীবী কারাগারের সামনে যান। পরে সেখান থেকে তারা যান কারা অধিদপ্তরে। সে সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, কিছু কাগজপত্রে ম্যাডামের সই লাগবে। এ কাজেই এসেছি। বেরিয়ে এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।প্রায় ৪৫ মিনিট পর তারা কারা অধিপপ্তর থেকে কারাগারের মূল ফটকে এসে অপেক্ষা করেতে থাকেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না মেলায় বেলা ৩টার দিকে ফিরে যান।সানাউল্লাহ মিয়া সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, আগামীকাল এ মামলার রায়ের কপি পেলে আমরা জামিনের জন্য আবেদন করব।এই আইনজীবী জানান, তারা কিছু ওকালতনামা এনেছিলেন। খালেদা জিয়ার সইয়ের জন্য সেগুলো কারা কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন তারা।কারা কর্তৃপক্ষ এগুলো গ্রহণ করেছে। তারা বলেছে, এগুলোতে স্বাক্ষর নিয়ে পরে আমাদের ফেরত দেবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খালেদা জিয়াকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর যে খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে তা সঠিক নয়।আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে জানতে চেয়েছি, বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে খবর এসেছে- তা আসলে ঠিক কিনা। তারা আমাদের জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সে রকম কোনো অর্ডার আসেনি।

সামনে গ্যাটকো, বড়পুকুরিয়াসহ তিনটি মামলায় খালেদা জিয়ার হাজিরার তারিখ রয়েছে। তবে এই মামলাগুলোতে খালেদা জিয়াকে নিজে উপস্থিত থাকতে হয় না। আইনজীবীর মাধ্যমেই তিনি হাজিরা দিতে পারেন বলে সানাউল্লাহ মিয়া জানান।কারাগারের একজন কর্মকর্তা বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তিনটি ওকালত নামা নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো গ্রহণ করে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালতের দেওয়া রায়ের অনুলিপির প্রিন্ট সম্পন্ন হয়েছে। এতে কোথাও ভুলভ্রান্তি হচ্ছে কি না, তা এখন দেখা হচ্ছে।আদালত সূত্রে জানা যায়, মূল রায় ৬৩২ পৃষ্ঠা হলেও রায়ের অনুলিপি হবে ছয় হাজার পৃষ্ঠার বেশি। ওই অনুলিপি হাতে আসার পরই জামিনের জন্য আপিল করতে পারবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত বৃহস্পতিবার থেকে কারাগারে আছেন। ওই দিনই ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান জিয়া ওই মামলায় রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদ- দেন আদালত। খালেদা জিয়ার প্যানেল আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, আদালতের রায়, এজাহার, সাক্ষী, জেরা, অভিযোগপত্র, ফরোয়ার্ডিংসহ সব কাগজ মিলে ছয় হাজার পৃষ্ঠার ওপরে অনুলিপি হবে। ওই অনুলিপি কোর্ট ফোলিওতে প্রিন্ট হয়ে গেছে। জয়নুল আবেদীন মেজবাহ জানান, পাঁচ থেকে ছয়জন অনুলিপিকারক এ নিয়ে কাজ করছেন। কোনো ভুলভ্রান্তি হচ্ছে কি না, তাঁরা তা মিলিয়ে দেখছেন। এ নিয়ে তাঁরা বেশ ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত পাচ্ছেন না তাঁরা।

জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, কারেকশনের পরে প্রধান অনুলিপিকারক চূড়ান্তভাবে মিলিয়ে দেখবেন কোনো ভুল হলো কি না। এর পরে তিনি সেই অনুলিপিতে স্বাক্ষর করবেন। তাঁর স্বাক্ষরের পরে ওই আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বাক্ষর করবেন। এর পরে অনুলিপিতে কোর্ট ফি লাগানো হবে। আর সব কাজ সম্পন্ন হলেই এ মামলার রায়ের কপি পাওয়া যাবে।ওই কপি দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করবেন বিএনপির চেয়ারপারসন। ওই আপিলে জামিনের আবেদন করা হবে। জামিন মঞ্জুর করা হলে ওই আদেশ ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে পাঠানো হবে। এর পরে আদালতে আবার জামিননামা দাখিলের অনুমতি চাইবেন আইনজীবীরা। বিচারক ওই জামিননামা দেওয়ার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়ার পক্ষে মুচলেকা (বন্ড) দিতে হবে। তখন একটি রিলিজ আদেশ কারাগারে পাঠানো হবে। ওই রিলিজ আদেশ পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবেন, যদি অন্য মামলায় গ্রেপ্তার না হন।গত ৮ ফেব্র“য়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী সলিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদন্ডাদেশ এবং দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সাজা ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। রায় ঘোষণার তিন দিন পর গত রোববার থেকে আদালতের নির্দেশে তাঁকে ডিভিশন বা প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।