আমার পাশে যে মহিলা বসে আছে, উনি সম্ভবত তার মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দিবেন। গল্পে উপন্যাসে লংজার্নিতে পাশের সিটে কোন সুন্দরী রমণী এসে বসে, মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ। তারপরে কিছু কথা, চোখাচোখি আর সবশেষে প্রেম। ট্রেন চলে ঝিকঝিক ঝিকঝিক। শুরু হয় নতুন এক গল্পের।

আমার বেলায় সারাজীবন উলটা ঘটে। পারফিউম দূরের কথা, মাঝবয়সী এই মহিলার থেকে বিকট পানের গন্ধ আসছে। পান খাওয়া আমার বিশেষ পছন্দের না। পানের গন্ধে মাথা ঝিম ঝিম করে।

আমি চিটাগাং যাচ্ছি, সকালের ট্রেনে। আমার একটা আইফোন কিনা দরকার। আসলে যা ভাবছেন তা নয়, আমি আইফোন কিনতে চিটাগাং যাচ্ছি না। আব্বার লাখ পাঁচেক টাকা আটকে আছে। তাগাদায় যাচ্ছি। আব্বা লোভনীয় অফার দিয়েছে।

গতরাতে হুট করে এসে বললেন পাঁচ লাখ তুলে দিলে ২০% তিনি আমাকে দিবেন। চিটাগাং দুইদিন থাকা খাওয়াও আব্বা দিবেন। একদিন তাগাদার জন্যে, একদিন চিটাগাং ঘুরে দেখার জন্যে। এই লোভনীয় প্রস্তাব শুনে সকালের ট্রেনেই রওনা দিয়েছি। রাতে আমি ঘুমাইনি। জানি ঘুমালে আর সকাল ৭টা৪০ এর মহানগর প্রভাতি আমি আর ধরতে পারব না।

ট্রেনে বসে ফেইসবুকে চ্যাট করছিলাম। ইদানিং একটা মেয়ের সাথে ভালোই কথাবার্তা চলছে। নায়ক-গায়ক তাহসানের পেইজে একটা নেগেটিভ কমেন্ট করেছিলাম। রিপ্লাইতে এসে মেয়ের সেই কি ঝগড়া। কিছু প্রেম ঝগড়া থেকে শুরু হয়। এখনো প্রেম না হলেও আমাদের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে প্রেম হয়ে যাবে।

স্টেশনে যেয়ে টিকিট কাটার সময় চাইলাম এসি বার্থের টিকিট। ব্যাটা টিকিট নাই বলে দিয়ে দিল শোভন চেয়ার। ট্রেনে উঠে দেখি সমস্ত ট্রেন ফাকা। ঈদের দুইদিন পরে ট্রেন তো ফাকা থাকবেই। ব্যাটা সম্ভবত সকালে বউয়ের সাথে ঝগড়া করে না খেয়ে আসছে, নইলে এমন খবিশের মত একটা কাজ করল কিভাবে!

আমার অবশ্য ক্লাস নিয়ে মাথাব্যাথা নেই, যেতে পারলেই হল। কতবার মালগাড়ি আর বাসের ছাদে শুয়ে ভ্রমণ করেছি ইয়াত্তা নেই। যারা সত্যিকারের ট্রাভেলার, তাদের ক্লাস নিয়ে ফোবিয়া থাকে না।

এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার ঘন্টাখানেক পরে সেই মোটা মহিলা এসে পাশে বসে পড়লেন। ঘুমায় পড়ছিলাম, উনি বসার পরে মনে হলো বগিটাই একটা ঝাঁকুনি খেলো। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে আবার ঘুমের চেষ্টা করলাম। মহিলা আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, চিটাগাং যাও?”
আমি হেসে বললাম, “জ্বি আন্টি।”

তিনি ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করলেন। পানের বাক্স। আমি হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শোনায় মন দিলাম। কিছুক্ষণ বাদে উনি আবার ডাকলেন, “বাবা, তুমি কি চিটাগাং থাকো?”

আমি না শোনার ভান করে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আবার ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে আমার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বাবা, তুমি কি চিটাগাং থাকো?”

আমি কান থেকে হেডফোন খুলে বললাম, “আন্টি কিছু বলবেন?”

মহিলা পানখাওয়া লাল দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, তুমি কি চিটাগাং থাকো?”

আমি ঢাকায় থাকি। চিটাগাংয়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে অনেক দিন আগে একবার চিটাগাং বেড়াতে এসে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েও রাজি হয়েছিল। কয়েকদিন মেয়ে আমাকে তার শহর ঘুরিয়ে দেখাল। আসার দিন সেই মেয়ের ভাই দেখে ফেলল। মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। সেই থেকে চিটাগাং প্রেম করার ব্যাপারে আমার বিশেষ ভীতি আছে। নেহাত টাকার লোভে আসা, সেই মাইরের ভয় আমার এখনো যায়নি।

আমি অমায়িক হেসে উত্তর দিলাম, “না আন্টি, আমরা ঢাকাতেই থাকি।”

মহিলা এবার কি যেন একটু ভাবলেন, তারপরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “চিটাগাং ঘুরতে আসছ বুঝি?”

আমি উত্তর দিলাম। বললাম আব্বার টাকা তুলতে আসছি।

এবার মহিলা খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন বাড়ি কয়টা, বাবা কি ব্যাবসা করে, ভাইবোন কয়টা, বিয়ে করছি কি না।

ট্রেন ব্রাক্ষণবাড়িয়া এসে থেমেছে। মহিলা কিছুক্ষণের জন্যে কোথায় যেন গেছেন। যাওয়ার আগে তার ব্যাগ আমার কাছে রেখে গেছেন। আমি ব্যাগটার দিকে তাকাই। সন্দেহ হয় ভিতরে বোম্বটোম্ব কিছু আছে কি না। আবার ভয় লাগে চুরির কেসে ফাঁসায় আমার সর্বস্ব লুট করে কি না। ইদানিং ভাওতাবাজি বেড়ে গেছে। সেদিন দেখলাম চার পাঁচজন মহিলা একটা গ্রুপ করে বাসে উঠে। তারপর মালদার কোন লোককে ধরে গায়ে হাত দেয়ার অজুহাতে। বাস থেকে নামিয়ে মারধর করে ব্যাটার টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়।

তবে এই মহিলাকে অবশ্য তেমন মনে হয় না। পোশাক ভাবভঙ্গি দেখে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হয়। তারপরেও ভয় করে। কথায় আছে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। চিটাগাং এর সেই মাইর আমার হাড়ে হাড়ে লেগে আছে। চিটাগাংয়ের মানুষ দেখলে সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে।

এককাপ চা নিলাম শরীরের মেজমেজ ভাব দূর করার জন্যে, চা খাওয়ার পরে এবার চেপেছে সিগারেটের নেশা। এদিকে মহিলার ব্যাগ রেখে গেলে কি না কি হয়। আবার নিয়ে বাইরে গেলে তো নির্ঘাত চোর হতে হবে। চুপচাপ বসে রইলাম।

আধাঘন্টা পরে মহিলা আবার এসে বসলেন। ট্রেন ততক্ষনে চলতে শুরু করেছে। কোথাথেকে যেন একটা বাক্স নিয়ে এসেছেন। বাক্স খুলতেই খাবারের মৌ মৌ ঘ্রাণ। পেটের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল। মহিলা সেই খাবার আমার দিকে আগায় দিয়ে বললেন, “খাও বাবা, বাসা থেকে বানায় আনছি।”

পেট সামাল দিয়ে বললাম,”না আন্টি আপনি খান। আমি বাসা থেকে খেয়ে আসছি।” পাছে আবার কি না খাওয়ায় সর্বস্ব কেড়ে নেয়।

মহিলা আপন মনে খাওয়া শুরু করল। আমার কেমন যেন উইয়ার্ড ফিলিং হচ্ছিল। আর একটু সাধলে কি দোষ ছিল? ক্ষুধা আমার ভালোই লাগছে। আর একবার বললেই খেয়ে ফেলতাম।

কিছুক্ষন বাদে মহিলা আরেকটা বাক্স নিয়ে হাজির। এবার একবার সাধার পরেই বললাম, “আহ আন্টি, কষ্ট করে বানাইছেন, না খাইলে তো আপনার খারাপ লাগবে।”

ট্রেন চলছে। দুপাশের গাছপালা ঘরবাড়ি পিছনে ফেলে ট্রেন চলছে। পেটে খাবার পরতেই দুনিয়াতে একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। ঘুম পায়। আমিও ঘুমায় পড়লাম। ট্রেন ফেণী স্টেশনে আসতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশের আন্টি আমার কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন।

ট্রেনে কই এক সুন্দরীর এই ভাবে ঘুমানোর কথা ছিল, আর ঘুমাচ্ছেন এই মাঝবয়সী মহিলা। হাত আমার ব্যাথা করছে। সোজা করা দরকার। মহিলার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তাই হাতও সোজা করতে পারি না। অকওয়ার্ড মোমেন্ট।

সেবার চিটাগাং যে মেয়ের সাথে কয়েকদিনের প্রেম হয়েছিল তার নাম ছিল বীথি। ছিমছিমে শরীর। দেখতে বেশ মিষ্টি। যখন চিটাগাংয়ের ভাষায় কথা বলে, তোতা পাখির মত মনে হয়। তবে শুদ্ধ বাংলা জানত। আমার সাথে শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলত।

এই মুহূর্তে সেই বীথি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চিনিতে অসুবিধা হয়নি। কয়েকদিনের হলেও, লাইফের প্রথম প্রেম ছিল। ভুলতে পারিনাই। মনে হলেই বুকটা চিনচিন করে। বীথি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,”তুমি? তুমি আম্মার সাথে কি করো?”

প্রশ্ন শুনে আমি স্তম্ভিত। আমি বিথীর আম্মার সাথে কি করব? আমার পুরান প্রেম আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ততক্ষনে। আমি নরম স্বরে বললাম, “ইনি তোমার আম্মা?”

বীথি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “তাইলে কার আম্মা?”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাইলে তুমি কোথায় বসছ, আর উনি এখানে কেন?”

“আর বইল না, এসিতে আম্মার বমি পায়। তাই আমরা সবাই এসিতে আর উনি সমস্ত ট্রেন ঘুরতেছেন?”

বীথির কথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা মানে, তোমার ভাইটাও সাথে আছে?”
বীথি হেসে উত্তর দিল, “না ভাইয়া সাথে নাই, স্টেশনে আসবে আমাদের নিতে।”

আমার হাড়গোড়ে ব্যাথা লাগে। বীথির কথা শুনে আমার হাড়গোড়ে ব্যাথা লাগে। এমন নৃশংস যে প্রেমিকার ভাই, সেই প্রেমিকের হাড়ে ব্যাথা লাগে। বীথির আম্মা এরই মধ্যে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা কি আগে থেকে পরিচিত?”

আমি আর বীথি একসাথে মাথা ঝাঁকায় বললাম, “নাহ।”
তিনি আবার আমার কাঁধের উপর ঘুমিয়ে পড়লেন।

ট্রেন চলছে। এই ট্রেন সাক্ষী হয়ে থাকে কত মান, অভিমান, ভালোবাসার। এই ট্রেন নিয়ে যার একজনের কাছ থেকে অন্যজনকে অনেক দূর। আবার এই ট্রেন এনে দেয় প্রিয় মুখ। এই ট্রেন সাক্ষী অসংখ্য ভালোবাসা আর বিরহের গল্পের।

ট্রেনের দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বীথিকে দেখছিলাম। সেই আগের মতই ছিমছাম। মায়াময় চোখ। বীথি সেই চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি না বলে চলে গিয়েছিলে কেন?”

আমি নির্বাক উত্তর দিলাম, “মাইরের ভয়ে। তোমার ভাই যে মাইর দিছে। এরপরে তোমার কাছে গেলে জান নিয়া বাড়িয়ে ফিরা লাগত না।”

বীথি ঠোঁট চেপে বলল, “আসলে তুমি আমাকে ভালোবাস নাই তখন। ভালোবাসলে মাইর কোন ব্যাপারনা।”

আসলেই ভালোবাসলে মাইর কোন ব্যাপার না। নইলে ভাগ্য কেন আবার বীথির সাথেই দেখা করাবে? আর স্টেশনে কেনইবা ওর সেই ভাই নিতে আসবে?

আমি কি আবার মাইর খেতে চলেছি?

Hafizur Rahman Rick