দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা নিয়ে দুর্নীতির খবর অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।দুদকের উপ পরিচালক শামসুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন সহকারী পরিচালক এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন ও উপ সহকারী পরিচালক এ এস এম তাজুল ইসলাম।আর দুদক পরিচালক কাজী শফিকুল আলমকে এই অনুসন্ধান কাজের তদারকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে উপ পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টচার্য জানান।

তিনি বলেন, দুদক আইন অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।খনির কোল ইয়ার্ড থেকে কয়লা ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ লাখ ১৬ হাজার টন কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি করে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বড় পুকরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবীব উদ্দিন আহমদ ও অন্যদের বিরুদ্ধে। এদিকে কয়লা সরবরাহ না পাওয়ায় বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন রোববার রাতে বন্ধ হয়ে গেছে।৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ওই কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগের আট জেলা বিদ্যুৎ সঙ্কটে পড়ায় বিকল্প পথ খুঁজছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।

প্রসঙ্গত,কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের সীমাহীন দায়িত্বহীনতায় জ্বালানি সংকটে পড়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো। রোববার (২২ জুলাই) রাত ১০টা ২০ মিনিটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (সংরক্ষণ) মাহবুবুর রহমান মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে তা নিশ্চিত করেছেন। তবে কবে নাগাদ পুনরায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হবে তা তিনি বলতে পারেননি। এদিকে, বড়পুকুরিয়া খনির কোল ইয়ার্ড থেকে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি খনি কর্তৃপক্ষ ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া খনির উপর নির্ভর করে খনির পার্শ্বে কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ও ১২৫ মেগাওয়াট করে দু’টি ইউনিট রয়েছে। কেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনে থাকলে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার ২শ’ মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হয়। ১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ১ নং ইউনিটটি বড় ধরনের (জেনারেল ওভারহোলিং) মেরামতের জন্য কয়েকমাস ধরে বন্ধ রয়েছে। ২ নং ইউনিটটি কয়লা সংকটের কারণে গত ২৯ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়লা সংকটের কারণে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩ নং ইউনিটটি কয়েকদিন ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে অবশেষে গত রাতে সেটিও বন্ধ হয়ে গেল।সূত্র মতে, বাস্তবে না থাকলেও বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ কাগজে কলমে বিপুল পরিমাণ কয়লার মজুদ দেখিয়ে পিডিবি’র সঙ্গে প্রতারণা করে। খনি কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা রেখে পিডিবি দেশের বাইরে থেকে কয়লা আমদানির না করায় প্রচন্ড গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেল।এরফলে দেশের উত্তর জনপদের লোকজনকে এখন বেশ ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে।

এদিকে, বড়পুকুরিয়া খনির কোল ইয়ার্ড থেকে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি খনি কর্তৃপক্ষ ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উৎপাদন, বিপণন ও নিজস্ব ব্যবহার নিরূপণের জন্য উপ-মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) জোবায়ের হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

সূত্র মতে, ২০০৫ সালের ১০ অক্টোবর বড়পুকুরিয়া খনি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ২৭ জুন পর্যন্ত কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে ২০০৬ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে বিক্রি করা হয় ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লা।এছাড়া ইটভাটাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয় ৩৩ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। খনি কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ ব্যবহার করে ১২ হাজার মেট্রিক টন। ‘সিস্টেম লস’ দেখানো হয় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। যার পরিমাণ উধাও হয়ে যাওয়া কয়লার সমপরিমাণ অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে খনি সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন।

কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলে খনির ইয়ার্ড থেকে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ায় বা হিসাবের গরমিলটি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদকে ওএসডি করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দফতরে সংযুক্ত করা হয় এবং মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও কোম্পানি সচিব) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড সিরাজগঞ্জে বদলি করা হয়। সেই সঙ্গে বড়পুকুরিয়া খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয় পেট্রোবাংলার পরিচালক আইয়ুব খানকে।একই সঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক (মাইন অপারেশন) কামরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত খনি এলাকায় আসেনি।