রপ্তানির নামে চার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবস্থা নিতে নথি পাঠানো হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছেও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান। আজ সকালে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৮) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে বেলা ১১টায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাজী হাসান এ তথ্য জানান। এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ঋণপত্র খোলা হলেও দেশে পণ্য আসছে না, রপ্তানি হলেও দেশে টাকা আসছে না।এর ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কি ভেঙে পড়েছে?’ গভর্নর ফজলে কবির এ প্রশ্নর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব দেন গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানকে। রাজী হাসান জবাবে ওই কথা বলেন।

সভায় আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বড় একটি প্রভাবশালী গ্রুপের আমদানি পণ্য দেশে না আসায় একটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছিল। চাপে পড়ে তা মাফ করা হয়েছে। এভাবেই তো অর্থ পাচার হচ্ছে?এর জবাব দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের ওপর। তিনি বলেন, পণ্য দেশে আসা নয়, জরিমানা করা হয়েছিল সময়মতো আমদানি নথি জমা না দেওয়ায়।গভর্নর ফজলে কবির এ সময় বলেন, ব্যাংকটি জরিমানা মওকুফের জন্য আবেদন করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিষয়টি দেখবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা কি ভেঙে পড়েছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পরিদর্শনে যেসব অনিয়ম ধরা পড়ছে, এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের যে সীমারেখা রয়েছে, এর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।সকালে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণায় সুদহার ও নীতিনির্ধারণীতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।বছরের প্রথমার্ধে লক্ষ্যের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হওয়ায় ভোটের আগে ‘সংযত’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের নতুন এই মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি জানুয়ারি-জুলাই মেয়াদের মুদ্রানীতির মতোই ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে।আর সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জানুয়ারি-জুলাই মেয়াদের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশের চেয়ে বেশি।গভর্নর ফজলে কবির এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় প্রবৃদ্ধিবান্ধব এবং একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখার লক্ষ্যে সংযত ধরনের মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়েছে।গভর্নর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, সরকারি খাতে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।এক প্রশ্নের উত্তরে ফজলে কবির বলে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি যদিও গতবারের মুদ্রানীতির মত ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে, কিন্তু সরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ থাকবে।মুদ্রানীতিতে বিধিবদ্ধ জমার (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ জমা রাখার হার) অনুপাত বা সিআরআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল আহরণের রেপো সুদের হারও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।বর্তমানে সিআরআর আছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। রেপো সুদের হার ৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর অর্থ সংকট কাটাতে গত এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত সিআরআর ও রেপোর হার কমিয়ে আনে। গভর্নর বলেন, আগের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, তা অর্জিত হয়নি। এ বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।এ জন্যই মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাবাচন সামনে রেখে সংযত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান বলেন, সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য ধরেছে, তা বাস্তবায়নে সহায়তা করতেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুলাই) মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়।অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।গত অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার আশা করা করা হয়েছিল।অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।সরকার চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ; আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার আশা করছে।

বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ঘোষিত আর্থিক নীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতি অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।বরাবরের মতো এবারও নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরী, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান, আহমেদ জামালসহ প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।