জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। এই যাত্রার বড় অংশীজন বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় ড. কামালের অংশগ্রহণ দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে বিএনপি।বিএনপি মনে করে, রাজনীতির গতিপথ, অর্থাৎ বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, একাদশ সংসদ নির্বাচনে কাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তা দেখে ছোট দলগুলো জাতীয় ঐক্যে যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহত্তর ঐক্য একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে আরও কিছুটা সময় নেবে।

বিএনপি বলছে, অনেক দলই জানতে চাইছে, বিএনপি ভোটে যাবে কি না। ভোটে গেলে কেউ কেউ নির্বাচনী জোটে আসতে চায়। আন্দোলনের জোটে সবাই থাকতে চায় না। এ কারণে আপাতত যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের সঙ্গে বিএনপি যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকছে। সামনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে বৃহত্তর ঐক্য কাঙ্ক্ষিত আকার পেতে পারে। এ জন্য অক্টোবর মাসটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তফসিলের আগেই ঐক্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।কিন্তু এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ নিয়ে বিএনপি এখনো সন্দেহমুক্ত নয়। বলা যায়, সেই সন্দেহের দানায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির নির্বাচনী পরিকল্পনা। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, বি চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও দলীয় চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর এই রাজনৈতিক জোটে ধাক্কা লাগতে পারে। কারণ, বি চৌধুরীর দল বিকল্পধারা সরকারবিরোধী জোটের পাশাপাশি সরকারি জোটের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বলে বিএনপির নেতারা মনে করেন।

তা সত্ত্বেও সরকারবিরোধী এই জোটকে টিকিয়ে রাখার জন্য নির্বাচনে বিএনপি থেকে ছোট অংশীজনদের সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার চিন্তাভাবনা আছে। এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আপাতত দূরত্ব রেখে চলা আরও কয়েকটি দল বৃহত্তর এই জোটে যোগ দেবে বলে বিএনপির নেতারা মনে করেন।বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক অলি আহমদ মনে করেন, বিকল্পধারা যেসব শর্ত বিএনপিকে দিচ্ছে, তাতে জাতীয় ঐক্যে বিএনপিকে না রাখার ইঙ্গিত। বি. চৌধুরী যখন বিএনপিতে ছিলেন, তখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য ছিল। বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে চলেছে। আর এখন বি. চৌধুরীর দল ঐক্যের জন্য জামায়াতবিরোধিতার যে কথা বলছে, তা মূলত বিএনপি দূরে রাখার কৌশল। তা ছাড়া তিনি প্রশ্ন করেন বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরী ভিওআইপির ব্যবসা করেন। এই ব্যবসা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই দিয়েছে।সম্প্রতি দলের এক অনুষ্ঠানে অলি আহমদ এসব কথা বলেছেন।বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের আগে আগে বিভিন্ন দল ও জোটে আরও অনেক ভাঙাগড়া হবে। কোন দল বা জোট ক্ষমতায় যাবে, তার পূর্বাভাস বেশ কিছু দলের গতি–প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে। বিকল্পধারাকে বিএনপি সেই গোত্রীয় দল বলেই মনে করে। এলডিপির ক্ষেত্রেও বিএনপি নেতাদের একই মত। দলটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের সদস্য। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে এলডিপির প্রধান অলি আহমেদ জোটের কোনো বৈঠকে অংশ নেননি। বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে অলি আহমেদ ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির তাতে আগ্রহ দেখায়নি। শেষ পর্যন্ত এই দলও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকবে কি না, রাজনীতির হাওয়া-বাতাস সেটা নির্ধারণ করে দেবে।

অবশ্য অলি আহমেদ বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের নেতারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে বিএনপির জোট হয়েছে, ২০দলীয় জোটের সঙ্গে নয়। একজন ডক্টর আর একজন ডাক্তার নিশ্চয় এই দুর্দিনে বিএনপিকে পথ দেখাবে। তবে আমরা ২০দলীয় জোটের সঙ্গে আছি।অবশ্য সার্বিক ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এসব বিষয়ে এখনো মন্তব্য করার মতো সময় আসেনি। কারণ, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখনো শুরু হয়নি। এটিকে সাংগঠনিক রূপ দিতে সময় লাগবে। সবে তো আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে আমরা যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও আমাদের দাবি-দাওয়া প্রায়ই এক।বিএনপি বলছে, ৫ অক্টোবর ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান ড. কামাল হোসেনের দেশে ফেরার কথা আছে। তিনি ফিরলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ হবে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গত ২২ সেপ্টেম্বর সমাবেশের মাধ্যমে বৃহত্তর সরকারবিরোধী জোটের যাত্রা শুরু হয়েছে। সেখানে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐক্যের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারার সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাপতি মওদুদ আহমেদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আবদুল মঈন খান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। নেতাদের পাশাপাশি সমাবেশে বিএনপির কর্মীদের উপস্থিতিই ছিল বেশি।সমাবেশে ড. কামাল বলেছেন, বৃহত্তর ঐক্যের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোট, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার আদায় করবেন। বি. চৌধুরী সরকারের পতন চেয়েছেন, গণতন্ত্র চেয়েছেন এবং সব রাজবন্দীর মুক্তি চেয়েছেন। কিন্তু আলাদা করে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার নাম মুখে নেননি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দুঃসময়ে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন ড. কামাল। তবে সমাবেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোটের শরিক দলের নেতাদের অনেককেই দেখা যায়নি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এলডিপির অলি আহমেদ ও কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম।

বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, সমাবেশে কোন দলের উপস্থিতি ছিল আর কোন দলের ছিল না এবং উপস্থিত বিভিন্ন দলের নেতারা কে কী বলেছেন, সেটা তাঁরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এসব নেতার মতে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ড. কামালের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া খুবই নগণ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছরের শাসনামলে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বর্ষীয়ান এই নেতার নেতৃত্ব সরকারের বিপক্ষের রাজনৈতিক জোটকে শক্তিশালী ভিতে দাঁড় করাতে সক্ষম বলে বিএনপি মনে করে।বি. চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন বলেই তাঁর ব্যাপারে বিএনপি একটু বেশি সতর্ক। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমে বি. চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য তিনি ২০০২ সালের ৩০ মে মৃত্যুবার্ষিকীর দিন জিয়াউর রহমানের সমাধি পরিদর্শন না করার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি বিএনপি নেতা-কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করে। তখন বিএনপির অনেক নেতা তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাবেরও পরিকল্পনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ ও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে বি. চৌধুরী ২১ জুন পদত্যাগ করেন।

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বি. চৌধুরী বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালের মে মাসে তিনি বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন। সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন বিএনপির আরেক নেতা এম এ মান্নান ও নিজের ছেলে মাহী বি. চৌধুরী। অবশ্য একই সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও মাহী বি. চৌধুরীর নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও দলের এই বিভাজনকে অনিবার্য করে তুলেছিল।এরপর ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর অলি আহমদের নেতৃত্বে ২৪ জন মন্ত্রী-সাংসদ বিএনপি থেকে বের হয়ে এলডিপি গঠন করেন। বি. চৌধুরীও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। কিছুদিন একসঙ্গে রাজনীতি করার পর বি. চৌধুরী আবারও বিকল্পধারাতে ফিরে যান। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বি. চৌধুরী দল বা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে যতটা ভাবেন, তার চেয়ে বেশি ভাবেন ছেলে মাহী বি. চৌধুরীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু বিএনপি, বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিতে রাজি নন।মাহী বি. চৌধুরী বলেন, জাতীয় ঐক্যে তো আমরা আগে থেকেই আছি, এখনো আছি। প্রশ্ন হলো বিএনপি কত দূর এগিয়ে? আমরা তো বৃহত্তর ঐক্যে তাদের চাই। বিএনপিকে আমরা শর্ত দিয়েছি জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে জোটে আসতে হবে। কিন্তু বিএনপি বলছে, তারা এককভাবে জাতীয় ঐক্যে আসবে। আলাদাভাবে নেতৃত্ব দেবে ২০দলীয় জোটের। সেখানে তো জামায়াত আছে। তার মানে, আমরা কি পরোক্ষভাবে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করব? সেটা তো হবে না।