চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার চাক্তাই বেড়া মার্কেট বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এতে শিশুসহ নয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একই পরিবারের চারজন, বাকিরা তিনটি পরিবারের সদস্য। পুড়ে গেছে প্রায় দুইশ ঘর।

রোববার ভোরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম স্টেশনের উপপরিচালক জসীম উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গভীর রাত সাড়ে ৩টার দিকে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট এসে উদ্ধারকাজ শুরু করে। নয়জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন রহিমা বেগম, তাঁর ছেলে জাকির হোসেন, মেয়ে নাজমা ও নাসরিন এবং প্রতিবেশী হাছিনা বেগম, আয়েশা বেগম ও সোহাগ। বাকি দুজনের মধ্যে একজন শিশু, তাঁর বয়স হবে সাত-আট মাস। অপর এক ব্যক্তিরও পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে—তা জানাতে না পারলেও উপপরিচালক বলেন, রাত ৩টা ৩২ মিনিটে আগুন লেগেছে। কী কারণে আগুন লেগেছে, তা আমরা নির্ণয় করতে পারিনি। চুলার আগুন হতে পারে, মশার কয়েল হতে পারে, বিদ্যুতের তার থেকে হতে পারে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের লেলিহান শিখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে, তা জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি খুঁজে দেখবে।এদিকে ঘটনার পরপরই জেলা প্রশাসনের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, গভীর রাতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটায় কোথা থেকে এর সূত্রপাত, তা জানা যায়নি। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের চারজন রয়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বেশি। প্রায় দুইশর মতো ঘর পুড়ে গেছে।

অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মাসুদুল হককে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে,’ যোগ করেন জেলা প্রশাসক।

বস্তিবাসী জানান, গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে, তখন হঠাৎ করেই তাঁরা প্রথমে ধোঁয়া ও পরে আগুন দেখতে পান। নিম্নবিত্তদের এই আবাস্থলে প্রায় সব ঘরেই কাঠ-টিন-প্লাস্টিক ব্যবহার করে বানানো। এর ফলে মুহূর্তের মধ্যেই আগুন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিকান্ডে বস্তির থাকার ঘরের পাশাপাশি গুদাম, দোকানপাটও পুড়েছে। সবাই ঘুমের মধ্যে থাকায় আগুন নেভানোর জন্য কেউ চেষ্টা করতে পারেনি। সবাই নিজেদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। নারী-পুরুষরা শিশুদের ঘুম থেকে তুলে যে যেভাবে পারেন, প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

তবে ঘর থেকে যাঁরা বের হতে পারেননি, তাঁরা ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছেন বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, নিহত ব্যক্তিদের লাশ ঘরের মধ্যেই পাওয়া গেছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা ঘর থেকে বের হতে পারেননি।

এক মেয়েকে কোনোমতে বাইরে এনে অন্য সন্তানদের আনতে জ্বলন্ত ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ভেড়া মার্কেট বস্তির রহিমা আক্তার। কয়েক ঘণ্টা পর ওই ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ রহিমার পোড়া লাশ।

শনিবার ভোর রাতে চাক্তাইয়ের রাজাখালী খাল সংলগ্ন ওই বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে ২০০ ঘর। জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন তিন পরিবারের আটজন।ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের ১০টি গাড়ি প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নেভাতে পারলেও ভেড়া মার্কেট বস্তির হাজার খানেক বাসিন্দা সর্বস্ব হারিয়ে এখন হতবিহ্বল।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সুরুজ মিয়ার স্ত্রী রহিমা (৫৫) ওই বস্তিতে বসবাস করে আসছিলেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওই বস্তিরই আরেক ঘরে থাকতে শুরু করেন।

তিন মেয়ে নাজমা আক্তার (১৬), নার্গিস (৯) ও নাসরিন (৫) এবং ছেলে জাকিরকে (১০) নিয়ে বস্তির দুটি ঘরে ছিল রহিমার সংসার। বস্তির পাশে একটি দোকান চালাতেন তিনি।

রহিমার ছোট ভাই পেশায় শ্রমিক মো. আকবরও একই কলোনিতে ভাড়া থাকেন। ভোরের আগুনে ঘর পুড়লেও প্রাণে বেঁচে গেছেন আকবর ও তার স্ত্রী।

আকবর বলেন, আগুন লাগার পর মেজ মেয়ে নার্গিসকে নিয়ে বের হয়ে আসছিল আপা। পরে ছোট মেয়েকে আনতে ভেতরে গেছিল। কিন্তু আর বের হতে পারেনি।

রাতে ঠিক কী ঘটেছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় রহিমার বেঁচে যাওয়া মেয়ে নার্গিসের কথায়।সে বলে, “ঘুম ভেঙে দেখি আম্মা ঘরের ভেতর ছুটোছুটি করতেছে। পরে আমার ভাই দরজা ভেঙে আমাকে কোনো রকমে বের করে দেয়।‘আম্মাও তখন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু নাসরিনকে আনতে আবার ঘরের ভেতরে ঢোকে। আর বের হতে পারেনি। ডাকাডাকি করেও কোনো আওয়াজ পাইনি।’

স্থানীয়রা জানান, রহিমার বড় মেয়ে নাজমা ঘরের কাজকর্ম করতেন। আর জাকির স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ত।ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রহিমার ঘরের কাঠামো ও জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ওই কলোনির বাসিন্দা হোসনে আরা স্থানীয় বিভিন্ন বাসায় বুয়ার কাজ করেন। এক হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় বস্তির একটি ঘরে থাকছিলেন তিনি। গভীর রাতে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে হোসনে আরা বুঝতে পারেন, বস্তিতে আগুন লেগেছে। বাইরে এসে দেখতে পান, কলোনির ভেড়া মার্কেট অংশের দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন।

প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। ঘর থেকে কিছুই আনতে পারিনি। আগুনে আমাদের সব গেছে। থাকার জায়গাটাও শেষ হয়ে গেছে।

রহিমার ঘরের কাছেই ছিল স্বামী পরিত্যক্তা আয়েশা আক্তারের (৩৭) ঘর। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আয়েশা ও তার বোনের ছেলে সোহাগের (১৯) পোড়া লাশ উদ্ধার হলেও তার নিজের মেয়ে ঋতু আক্তারের (১২) কোনো খোঁজ পাননি স্বজনরা।

সোহাগের খালাতো ভাই রুবেল বলেন, গার্মেন্টে চাকরি করে মেয়েকে মানুষ করার চেষ্টায় ছিলেন তার খালা আয়েশা। আর সোহাগ স্থানীয় একটি চায়ের একটি দোকানে কাজ করতেন।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, মোট আটজনের লাশ তারা উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে একজনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। লাশটি এতটাই পুড়ে গেছে যে নারী না পুরুষ তাও বোঝা যাচ্ছে না।

বাকলিয়া থানাধীন চাক্তাই ভেড়া মার্কেট সংলগ্ন রাজাখালী খালের পাড় এবং কর্ণফুলী নদী তীর সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ সড়কের লাগোয়া জমিতে ওই বস্তিতে ছিল দুই শতাধিক ঘর।