সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফায়ারম্যান সোহেল রানার মৃত্যুর খবরে তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়াইল গ্রাম শোকস্তব্ধ হয়ে গেছে। স্বজন হারানোর বেদনায় দিশেহারা হয়ে গেছে পরিবারটি। সোহেলের বাড়িতে চলছে বাবা-মা, ভাই- বোনের আহাজারি। তার বাবা বিলাপ করে বলছিলেন, বনানীর আগুন আমাদের সব কেড়ে নিলো।

দরিদ্র পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চলে যাওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ ও স্বপ্ন।
২০১৫ সালে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন সোহেল। সর্বশেষ কাজ করতেন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনে। তিন ভাইয়ের পড়াশোনা আর পরিবারের খরচ সবই ছিল তার কাঁধে। জরাজীর্ণ বাড়িটি ভেঙে নতুন করে বাড়ি করার কথা চলছিল। তাকে বিয়ে দেওয়ারও কথা হচ্ছিলো। কিন্তু সোহেলের এক কথা, ভাইদের প্রতিষ্ঠিত না করে বিয়ে করবেন না তিনি। এসব কথাই বুক চাপড়ে বিলাপ করে বলছিলেন মা হালিমা খাতুন। প্রিয় সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে আবদার করছেন লোকজনের কাছে।সোহেল রানার বাবা নুরুল ইসলাম বিলাপ করে বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আমার ছেলের জীবন গেলো। বনানীর আগুন আমাদের সব কেড়ে নিল।

মা হালিমা আক্তার বিলাপ করে বলছেন, আমার ছেলেকে আর ফিরে পাবো না। আল্লা, তুমি কেন আমার ছেলেকে এভাবে কেড়ে নিলে? এতো মানুষের জীবন বাঁচালো যে ছেলে, তাকে কেন তুমি কেড়ে নিলে?

সোহেলের স্বজনরা বলেন, সোহেল দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তবে তাদের পুরো পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। বাবা নূরুল ইসলাম অসুস্থ এবং মায়ের শরীরেও বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। বাবাকে হজ করিয়ে আনার কথা বলেছিলেন সোহেল। দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোয় বাবা-মা দুজনই আশা করেছিলেন তাদের সন্তান সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে।

চার ভাইয়ের মধ্যে সোহেল ছিলেন সবার বড়। ছোট দুই ভাই রুবেল ও উজ্জ্বল স্নাতকের ছাত্র। সবার ছোট ভাই দিলুয়ার আগামী বছর এসএসসি দেবে। তাদের সবার আশা ও ভরসার একমাত্র জায়গা ছিল বড় ভাই সোহেল। ছুটি কাটিয়ে গত ২৩ মার্চ কর্মস্থলে ফিরে যান সোহেল রানা। যাওয়ার আগে তিন ভাইকে ভালোভাবে পড়াশোনার করার কথা বলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা না করতে। তিনি বেঁচে থাকলে সবই হবে। পয়লা বৈশাখ বাড়িতে ফিরে সবাইকে নিয়ে বৈশাখী উৎসব করবেন। কিন্তু ভাইকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন সবাই।

সোহেলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন পরিবারটিকে সান্ত¡না দিতে তাদের বাড়িতে সকাল থেকে ভিড় জমায়। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে পাড়া-প্রতিবেশীদেরও কাঁদতে দেখা যায়।

ছোট ভাই রুবেল মিয়া বলেন, ভাইয়া আমাদের বাবার মতো ছিলেন। ছোট-বড় সব আবদার ভাইয়ার কাছেই করতাম। আমাদের পরিবার ভাই চালাতেন। তিনি চাকরি পাওয়ার পর থেকে আমরা কিছুটা ভালো ছিলাম। আমার ভাই বীরের মতো মারা গেছেন।

প্রতিবেশী সালাউদ্দিন বলেন, সোহেল অনেক ভালো ছেলে ছিল। পরিবারের লোকজন তাকে বিয়ের জন্য বলেছিল। সোহেল তাতে রাজি হয়নি। সোহেল চেয়েছিল ছোট ভাইদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করে পরে বিয়ে করবে। পরিবারের প্রতি প্রচ-রকম দায়িত্ববোধ ছিল। সব সময় হাসি-খুশি থাকতো। আমরা সোহেলকে নিয়ে গর্বিত। দেশের জন্য, মানুষের জন্য সে জীবন দিয়েছে। সরকারের কাছে আবেদন করবো যেন এই অসহায় পরিবারটাকে দেখে রাখে। বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে উদ্ধার কাজ চালাতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হন সোহেল। গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ২টার দিকে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সোহেলের মরদেহ বাংলাদেশে পৌঁছবে। সেখান থেকে রাতেই লাশ বাড়িতে পাঠানোর কথা রয়েছে। আগামীকাল গ্রামের বাড়িতে তার দাফনের কথা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুন নেভাতে ও আটকেপড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা। সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার বজলুর রশীদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন তিনি।সোহেল রানার আহত হওয়া প্রসঙ্গে বজলুর রশীদ বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেই বড় স্বয়ংক্রিয় মই (লেডার) দিয়ে ভবনে পানি দিচ্ছিলাম। লেডারে করে আটকেপড়া ব্যক্তিদের নামিয়ে আনছিলাম। সোহেল রানা একটি লেডারে ছিল। একটি লেডারে সর্বোচ্চ চার থেকে ছয়জন লোক ধরে। এর বেশি আনা যায় না। সোহেল রানা এবং আরও দুজন ফায়ারম্যান একটি লেডার নিয়ে আটকেপড়া কয়েকজনকে উদ্ধার করে। কিন্তু লেডারে জায়গা হচ্ছিল না। আটকেপড়াদের জায়গা করে দিতে সোহেল রানা লেডারের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিলেন। কিন্তু লেডারটি যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচের দিকে নেমে আসছিল, তখনই হঠাৎ সোহেল রানার পা মইয়ের ভেতরে আটকে গিয়ে ভেঙে কয়েক ভাগ হয়ে যায়। একই সময়ে চাপ লেগে তার পেট ছিদ্র হয়।

ফায়ারম্যান সোহেল রানার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায়। বাবা নূরুল ইসলাম ও মা হালিমা খাতুন। চার ভাই এক বোনের মধ্যে রানা দ্বিতীয়।