৭০ থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের ও প্রিয় মানুষ হিসেবে যিনি পরিচিত তিনি হলেন ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার তোসরা গ্রামের কৃতিসন্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা শেখ আকরাম হোসেন। যদিও তিনি প্রথমে ফকিরাপুল পুলপাড়ের পানির ট্যাংকির গলিতে বসবাস করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তার বাড়িতে একাধিক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে বাসাবো নয়ন ভিলায় বসবাস শুরু করেন এবং বীরমুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করেন। এসময় পাকহানাদার বাহিনী দুইবার তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে আক্রমন করে। কিন্তু তার স্ত্রী সাহারা বানু করাচি থেকে ইন্টার পাশ করায় উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তার কল্যাণেই সে দফায় শেখ আকরাম জীবন ফিরে পেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে গিয়েছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পাশে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ আকরাম হোসেন। শেখ আকরাম হোসেনের স্ত্রী সাহারা বানু তাদের মেয়েদের সামনে গল্প করতেন আজকের প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাকে হাত ধরে নিয়ে ইডেন কলেজেও অনেকবার গিয়েছিলেন আকরাম হোসেন। যা ইতিহাসের পাতার অতল গহ্বরেই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পূর্বেই খিলগাঁও বাজারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ আকরাম হোসেন। ৭ জনকে নিয়ে এই বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি এবং বাজার সংলগ্ন মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই বাজারে রাত ৮ থেকে ৮.৩০টার সময় দুর্বৃত্তরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ৬ দিন জীবন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে পরাস্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান ইতিহাসের এই কিংবদন্তী মানুষটি।

তৎকালীন সময়ে এ বিষয়টি দৈনিক ইত্তেফাক সহ সকল জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই প্রতিষ্ঠিত খিলগাঁও মসজিদে জানাযা শেষে শাহজাহানপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। দেখতে দেখতে ইতিহাসের পাতা থেকে ৪৬ বছর কেটে গেল। আগামী ১০ জুলাই তার ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই কীর্তিমান পুরুষের মৃত্যুবার্ষিকীতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। তার মেজ মেয়ে শামীমা আক্তার সুপ্তা আক্ষেপ করে বলেন, আমার বাবা বেঁচে থাকলে আজ আমাদের এই দুর্দিনে পড়তে হতো না। বাবার সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মধুর সম্পর্ক ছিল। আমরা ছেলে বেলায় অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু সেই গল্প বলার এখন আর কেউ নেই। যুগের পর যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও আমার বাবাকে কেউ স্মরণ করে না। আমারও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বিভিন্নভাবে রোগে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তার স্বামী শেখ ফেরদৌস আলী বলেন, আমরাও স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত। আমার শ^শুর অনেক বড়মাপের নেতা ছিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে কেউ কোনদিন কোন কর্মসূচি পালন করেনি। তার মৃত্যুবার্ষিকী এলে আমরা নীরবেই তার জন্য বাড়িতে বসেই দোয়া অনুষ্ঠান করি। মরহুম শেখ আকরাম হোসেনের একমাত্র ছেলে তাসাদ্দুক হোসেন রানা, বড় মেয়ে সাকিলা জামান শান্তা এবং ছোট মেয়ে শরীফা মোস্তাক শোভা ছাড়াও অনেক নাতি-নাতনী রয়েছে। পারিবারিকভাবে ৪৬ বছর পর মেজ মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবার নামে একটি স্মৃতি সংসদ তৈরী করবে এবং সেই স্মৃতি সংসদের ব্যানারে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ও জন্মবার্ষিকী পালন করবে। তার মেয়ে এখনো যারা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তাদের সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা যারা আমার বাবাকে দেখেছেন আপনাদের কাছে অনুরোধ আমার বাবার সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের স্মৃতির পাতা থেকে লিখুন। আপনাদের এই লেখাই আমার বাবা ইতিহাসের পাতায় নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবেন। মরহুম শেখ আকরাম হোসেন সম্পর্কে তার পরিবারের কাছ থেকে আরও জানা যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদসহ প্রবীণ নেতাদের সাথে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ৭০’র নির্বাচনে তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেব তাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন এবং সেই চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন আকরাম ভাই আপনি এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে দলকে সহযোগিতা করুন। পরবর্তীতে নির্বাচন করবেন। সেদিনের সেই চিঠির মূল্যায়নও করেছিলেন শহীদ শেখ আকরাম হোসেন।