বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম আহরণের তিন দিন পর আহরণকারীরা সংগৃহীত ডিমগুলো দুই পদ্ধতিতে পরিস্ফুটনের মাধ্যমে তা রেণুতে পরিনত করেছে।

বুধবার (২৯ মে) থেকে হালদা পাড়ের জেলে পল্লীতে শুরু হয়েছে রেণু বিকিকিনির মহোৎসব। এতে করে জেলেদের আতœ-সামাজিক অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন হালদা বিষয়ে বিজ্ঞমহল। হালদার তীরবর্তী জেলে পল্লীতে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে মৎস্য চাষী ও মৎস্য খামারীরা। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পালা শেষ জেলে পল্লীতে এখন নেমে এসছে খুশির আমেজ। তবে এ খুশির আমেজে কিছু ভাটা ফেলেছে তীব্র তাপদাহ। আর এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে দিনতিপাত করছে আহরণকারীরা।

জানা গেছে, গত শনিবার (২৫ মে) মধ্যরাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত প্রায় ২৩০টি নৌকা নিয়ে ৫ শতাধিক জেলে হালদা নদী থেকে রুই জাতীয় মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে। সংগৃহীত ডিম সনাতন পদ্ধতিতে ও আধুনিক পদ্ধতিতে হ্যাচারীর মাধ্যমে পরিস্ফুটনের পর রেণুতে পরিনত করে। বুধবার সকাল থেকে আহরণকারীদের এসব রেণু বিক্রির খবর পেয়ে চট্টগ্রাম জেলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে খামার মালিক, মৎস্য চাষী ও রেণু ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার প্রহর শেষ জেলে পল্লীতে খুশির আমেজ নেমে এসেছে। বাধ ভাঁঙ্গা অনন্দের জোয়ারে ভাসছে জেলে পরিবারের সদস্যরা। তাই তারা এখন রেনু বিকিকিনিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রতি কেজি রেনু ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দুপুর ১টার দিকে সরেজমিনে উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের মাছুয়াঘোনা হ্যাচারী গেলে দেখা যায়, ওই এলাকার ডিম আহরণকারী মুহাম্মদ জামশেদ ও মো. শফি চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলা থেকে আগত মোহাম্মদ দিদারুল আলমের কাছে ৩৬ হাজার টাকায় ৪৫০ গ্রাম, মো. মাহাবুব ও মো. লোকমান নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা থেকে আগত মো. মনিরের কাছে ৪৮ হাজার টাকায় ৬০০ গ্রাম, মুহাম্মদ খলিল ফেনী থেকে আগত আব্দুল কাদেরের কাছে ২৮ হাজার টাকায় ৩৫০ গ্রাম এবং মুহাম্মদ ইউসুফ ও ইব্রাহিম কুষ্টিয়া থেকে আগত হিমনের কাছে ১ লক্ষ টাকায় ১ কেজি ২৫০ গ্রাম রেণু বিক্রি করে।

হালদা সংগৃহীত রেণু গুলো কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই পরিপূণতা লাভ করার পর ৮০ হাজার টাকা কেজি দরে বাজারজাত তথা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ক্রিতাদের কাছে বিক্রি করতে পেরে মহাখুশিতে দিনাতিপাত করছে ডিম আহরণকারীরা। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পালা শেষ জেলে পল্লীতে এখন নেমে এসছে বাধভাঁঙ্গা খুশির আমেজ এমনটা জানিয়ে ডিম আহরণকারীরার জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে এসে রেণুগুলো কিনে নিচ্ছে মৎস্য চাষী, মৎস্য ব্যবসায়ী ও খামারীরা। তারা রেণুগুলো কিনে নিয়ে পোনায় পরিণত করে দফায় দফায় বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করবে। আবার কেউ কেউ তাদের নিজস্ব পুকুর বা জলাশয়ে মাছ চাষ করবে।

এদিকে, খুশির আমেজে কিছু ভাটা ফেলেছে সম্প্রতি দেশে চলতে তীব্র তাপদাহ। আর এ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে আহরণকারীরা। তীব্র গরমের কারণে বেকায়দায় পড়েছেন। গত দুই দিনে বেশ কিছু মাটির কুয়ার রেণু মরে গেছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে তুলনামূলক সরকারি হ্যাচারিগুলোতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তবে মাটির কুয়া দিয়ে ডিম আহরণকারীরা তুলনামূলক সমস্যা আছেন বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিশ্চুক এ হাটহাজারী উপজেলা গড়দুয়ারা ইউনিয়নের এক ডিম আহকারী রেণু মরে যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, বিগত কয়েক দিনের তীব্র গরমে এখানকার বেশ কিছু মাটির কুয়ার রেণু নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে নয়াহাট, সিপাহীর ঘাট, পোড়াকপালি, খলিপার ঘোনা ও বাড়িয়াঘোনা মাটির কুয়ার রেণু মরে গেছে।

হালদা থেকে সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম পরিস্ফুটনের জন্য রাখা মাটির কুয়ার রেণু কেন মারা যাচ্ছে জানতে চাইরে মুঠোফোনে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, সম্প্রতি দেশে চলতে তীব্র তাপদাহ। গরমের কারণে কুয়ার এসব রেণু অনাঙ্কাকিতভাবে মারা পড়ছে। এজন্য মাটির কুয়ার পানি দ্রুত পরিবর্তন করতে হবে এবং পানি সরবরা হসর্বদা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অন্যথায় এর ব্যত্যয় ঘটলে রেণু মরে যাবে।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় তিন দিন পর থেকে হালদা পাড়ে চলছে খুশির মহোৎসব এমনটা দাবী করে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মাদ রুহুল আমীন বলেন, হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট, শাহ মাদারি ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিগুলো সার্বিক নজরদারি রাখা হয়েছে। প্রতিদিন হ্যাচারিগুলো পরিদর্শন করছি। ডিম আহরণকারীদের সব রকমের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। তীব্র গরম পড়লেও তুলনামূলক সরকারি হ্যাচারিগুলোতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, হালদা নদীর মা-মাছের নিষিক্ত ডিম থেকে পরিস্ফুটনকৃত রেণু হ্যাচারি রেণুর চেয়ে হালদার পোনা দ্রুত বর্ধনশীল বলে এ পোনার কদর সারা দেশে। ডিম সংগ্রহকারীরা নদী থেকে সংগৃহীত ডিম সরকারী হ্যাচারী অথবা স্থানীয়ভাবে মাটির কুয়ায় রেণু ফুটিয়ে দফয় দফায় বিক্রি করে। রেণুর আয় দিয়ে পুরো বছর জীবিকা নির্বাহ করে আহরণকারীরা।