ভাড়া নিয়ে বিতন্ডার জেরে যাত্রীকে বাসের চাকায় পিষে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আলম এশিয়া পরিবহনের বাসের চালক ও কন্ডাক্টরকে মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত-১ এ প্রেরণ করা হয়েছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাদেরকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন ওই আদালতের বিচারক মোছাঃ শামীমা খাতুন।

গাজীপুর আদালতের ইন্সপেক্টর মীর রকিবুল হক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জয়দেবপুর থানার এসআই আব্দুর রহমান ভুইয়া জানান, ঈদ শেষে ফেরার পথে ভাড়া নিয়ে বাকবিতন্ডার জেরে সালাহ উদ্দিন নামের এক যাত্রীকে গাজীপুরের বাঘের বাজার এলাকায় বাস থেকে লাথি মেরে নীচে ফেলে তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় ঘাতক ড্রাইভার রোকন উদ্দিনকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া থানা সীমান্ত এলাকা হতে ও কন্ডাক্টর আনোয়ার হোসেনকে শেরপুরের নন্দী বাজার এলাকা থেকে সোমবার গ্রেফতার করে জয়দেবপুর থানা পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। পরদিন মঙ্গলবার গ্রেফতারকৃতদের গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত-১ এর বিচারক মোছাঃ শামীমা খাতুনের আদালতে পর্যায়ক্রমে হাজির করা হয়।

পুলিশের ওই কর্মকর্তারা জানান, মামলার প্রধান আসামী গ্রেফতারকৃত ড্রাইভার রোকন উদ্দিনকে বেলা আড়াইটার দিকে ওই আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে সে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে। প্রায় এক ঘন্টা ব্যাপী স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান কালে রোকন উদ্দিন পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের পর বিকেল সোয়া ৫টার দিকে একই আদালতে মামলার অপর আসামী গ্রেফতারকৃত কন্ডাক্টর আনোয়ার হোসেনকে হাজির করা হয়। আদালতে আনোয়ার হোসেনও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাদেরকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন ওই আদালতের বিচারক মোছাঃ শামীমা খাতুন। গ্রেফতারকৃত বাস চালক রোকন উদ্দিন (৩৫) ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার লতিফপুর গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে এবং কন্ডাক্টর আনোয়ার হোসেন (৩০)শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থানার পোড়াগাঁও গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে।

রোকন উদ্দিন তার স্বীকারোক্তিতে জানায়, ঈদ শেষে গাজীপুরে ফেরার পথে রবিবার দিন ময়মনসিংহের ফুলপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাসে চড়েন সালাহ উদ্দিন। বাসে উঠার সময় সালাহ উদ্দিন দু’জনের বাসভাড়া বাবদ মোট পাঁচশ’ টাকা নির্ধারণ করেন। পথে তারাকান্দা এলাকায় পৌছলে কন্ডাক্টর সালাহ উদ্দিনের কাছে ভাড়া দাবী করে। এসময় নিজেকে গাড়ি চালক পরিচয় দিয়ে সালাহ উদ্দিন নির্ধারিত বাসভাড়া থেকে ৫০ টাকা করে দু’জনের মোট একশ’ টাকা কম দিতে চাইলে বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। বেশ কিছুটা সময় ধরে তাদের মাঝে বাকবিতন্ডা চলে। এসময় সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার ও সহকারীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। একপর্যায় বাসের অতিরিক্ত হেলপার সারোয়ারের হস্তক্ষেপে সালাহ উদ্দিন নির্ধারিত ভাড়া ৫শ’ টাকার পুরোটা পরিশোধ করেন। এঘটনার পর বাসটি যাত্রী নামাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে থামলে সালাহ উদ্দিন বাস থেকে নেমে তার লোকজনকে নিয়ে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে বাসের কর্মচারীদের মারধর করতে থাকে। এসময় বাসটি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে ডান পাশের সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাহ উদ্দিন নিহত হন।

ওস্তাদ গাড়ি টান দেন মানুষ নীচে পইরা মরলে আমি বুঝমু !!
গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আফজাল হোসেন গ্রেফতারকৃত বাস ড্রাইভার রোকন উদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, আলম এশিয়া পরিবহনের ওই বাসটির মূল চালক ছিলেন আজিজুল ইসলাম। রোকন উদ্দিন তার পরিবর্তে বদলী ড্রাইভার হিসেবে প্রথমবারের মতো ঘটনার দিন ওই বাস চালাচ্ছিলেন। এর আগে রোকন উদ্দিন ইসলাম পরিবহন, ইমাম পরিবহনসহ ওই রুটের অন্যান্য পরিবহনের বাস চালাতেন। ঘটনারদিন রবিবার বাসভাড়া নিয়ে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে বাসটি যাত্রী নামাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে থামলে সালাহ উদ্দিন থামে। এসময় সালাহ উদ্দিন বাস থেকে নেমে পূর্ব থেকে স্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ তার লোকজনকে নিয়ে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে বাসের কর্মচারীদের মারধর করতে থাকে। এসময় অবস্থা বেগতিক দেখে বাসের হেলপার ওস্তাদ গাড়ি টান দেন মানুষ নীচে পইরা মরলে আমি বুঝমু। হেলপারের এ কথায় কয়েক যাত্রীকে না নামিয়েই বাসটি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে ডান পাশের সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাহ উদ্দিন নিহত হন।

মায়ের প্রতি ভালবাসার কারণেই চালককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে !!
মায়ের প্রতি ভালবাসার কারণেই ঘাতক ড্রাইভার রোকন উদ্দিনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জয়দেবপুর থানার এসআই আব্দুর রহমান ভুইয়া জানিয়েছেন।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর বাসটিকে গাজীপুর সড়র উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার ফুয়াং কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে ঘাতক ড্রাইভার রোকন উদ্দিন ও তার সহকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রোকন উদ্দিন ভুলক্রমে তার মোবাইল ফোনটি বাসে ফেলে রেখে যায়। পুলিশ বাস থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। তবে ঘাতক চালকের নাম পরিচয় অজ্ঞাত থাকে। পুলিশ ময়মনসিংহের বাস টার্মিনাল এলাকা ও তার ভাড়া বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ঘাতক চালকের সন্ধান করতে থাকে। পরে একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া এলাকায় রোকন উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালাতে যায়। এসময় ঘাতক বাস চালক রোকন উদ্দিন তার মা’কে নিয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে রোকন উদ্দিন পার্শ্ববর্তী কংস নদীতে ঝাপ দেয়। এসময় পুলিশ এলাকাবাসীদের সহযোগিতায় নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে রোকন উদ্দিনকে গ্রেফতার করে। ঘটনার সময় রোকন উদ্দিনের মা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তিনি আরো জানান, মায়ের প্রতি ভালবাসার কারণেই ঘাতক ড্রাইভার রোকন উদ্দিনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনার পর মা’কে সঙ্গে নিয়েই সে বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। মা তার সঙ্গে থাকার কারণেই বাংলাদেশ সীমান্ত পার হতে বিলম্ব হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা গেছে। তা না হলে সে দালালের মাধ্যমে ঘটনার পরপরই ভারতে পাড়ি জমাতো।

জয়দেবপুর থানার ওসি আসাদুজ্জামান ও নিহতের স্ত্রী ভাই জামাল উদ্দিন জানান, ঈদের ছুটি শেষে স্ত্রী পারুল আক্তারকে নিয়ে রবিবার ময়মনসিংহের শ্বশুর বাড়ী থেকে আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে চড়ে গাজীপুরের বাসায় ফিরছিলেন স্থানীয় স্কটেক্স এ্যাপারেলস পোশাক কারখানার গাড়ি সালাহ্ উদ্দিন (৩৫)। পথে তার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ওই বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার, সুপারভাইজার ও চালকের বাকবিতন্ডা হয়। নিজেকে গাড়ি চালক পরিচয় দিয়ে সালাহ উদ্দিন কিছু টাকা কম দিতে চাইলে এ বাকবিতন্ডা হয়। এসময় বাসের কন্ডাক্টর ও সহকারীরা সালাহ উদ্দিনকে লাঞ্চিত করে এবং হুমকি দেয়। বাকবিতন্ডার জেরে বাসের কন্ডাক্টর-হেলপার ও তাদের সহকারীরা সালাউদ্দিনকে মারধর করতে পারে এ আশংকায় সালাউদ্দিন তার ভাই জামাল উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে গাজীপুরের বাঘেরবাজার বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলেন। খবর পেয়ে জামাল উদ্দিন ওই বাস স্ট্যান্ডে এসে ভাই ও ভাবীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বাসটি বাঘের বাজার এলাকায় পৌছলে বাসের শ্রমিকরা লাথি মেরে সালাহ উদ্দিনকে বাস থেকে নীচে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ফেলে দিয়ে তার স্ত্রীকে না নামিয়ে চালক বাসটি নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় সালাহ্ উদ্দিন ও তার ভাই জামাল উদ্দিন গতিরোধের জন্য বাসের সামনে দাঁড়ালে চালক সালাউদ্দিনকে চাপা দিয়ে বাসটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এতে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে সালাউদ্দিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে সালাউদ্দিনের স্ত্রীকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দুরে মহাসড়কের আমতলা এলাকায় বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এঘটনার পর বাসটিকে স্থানীয় হোতাপাড়া এলাকার ফুয়াং কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে বাসের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার ও সুপারভাইজারসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাসটিকে পরিত্যাক্ত অবস্থায় জব্দ করে। এ ঘটনায় রাতে নিহতের ছোট ভাই জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাসের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার ও সুপারভাইজারকে আসামী করা হয়। নিহত সালাহ্ উদ্দিন (৩৫) গাজীপুরের স্কটেক্স এ্যাপারেলস পোশাক কারখানার গাড়ি চালাতেন।