বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, তাকে আনাড়ি ছেলেদের ফুটবল খেলার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। মাঠের যেখানে ফুটবল যায় সেখানে সবাই জট পাকায়। কখনো কখনো গোলরক্ষকরাও নিজ জায়গা ছেড়ে দিয়ে ফুটবলের পেছনে সারা মাঠ চষে বেড়ায়। সবার লক্ষ্য ফুটবলে লাথি মারা। কার লাথি খেয়ে বল কোন গোলে ঢোকে সেদিকে কারো খেয়াল থাকে না। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা অবস্থা দাঁড়িয়েছে আনাড়ি খেলোয়াড়দের ফুটবল খেলার মতো। যখন যে ঘটনা ঘটছে সে ঘটনার পিছনে গোটা জাতি ছুটছে। এরপর ঘটছে নতুন ঘটনা। সে ঘটনার পেছনে ছুটছে সবাই। ফলে কোনো সমস্যার সমাধান মিলছে না। অসংখ্য সমস্যার বাঁধছে জট। পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়।

দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নয়নে কড়া নজর দিতে হবে। আমাদের জন্ম গরীব দেশে। এর জন্য কাউকে দোষারোপ করবো না, তবে দুঃখ প্রকাশ করবো, যখন দেখবো যে ভালো ভালো সুযোগ রয়েছে আমাদের সামনে, অথচ আমরা তার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে যে সমস্ত দেশ রয়েছে তার বেশির ভাগ দেশই ভ্রমণ করার সুযোগ আমার হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগ করেছে। আমি যেহেতু দেশের পরিকাঠামো নিয়ে নানা বিষয়ের উপর লিখেছি, তো বিশ্বের সমস্ত বাংলাদেশি দূতাবাস সম্পর্কেও আমার ভাবনা থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। কারণ কুটনৈতিক এবং দূতাবাসের কাজ কর্মের উপর বা এদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে,
কিন্তু দেশের কোথাও কুটনৈতিকদের নিয়ে আলোচনা হয় বলে আমার চোখে পড়েনি আজও।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং তাদের দ্বায়িত্বে থাকা দূতাবাসসমূহের ব্যবস্থাপনার জন্যে যে বাজেট, সেই মোতাবেক রিটার্ন কি তাঁরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে দিচ্ছে? তার কি কোন খবর আমরা রাখি? আমি শুনেছি তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সময় নষ্ট করেন। তেমন কোনো সৃজনীশীল কর্মকাণ্ডে তাঁদের দেখা যায় না, যার ফলে তেমন কোনো আশা ব্যাঞ্জক ফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না। বাংলাদেশের জনগণের জানা দরকার এসব কুটনৈতিকদের কী কাজ এবং জাতি এদের থেকে কী প্রত্যাশা করে।

একটি গরীব দেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে দরকার সমবেত প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টাগুলোর একটি হল আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। আর সে কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ তার দুতাবাসগুলো স্থাপন করে রেখেছে, যাতে করে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সব সুযোগ সুবিধা ঠিকমতো ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিপদে আপদে বন্ধু দেশগুলো পাশে এসে দাঁড়াতে পারে!

বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, এবং প্রয়োজন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। আমরা যেমন বিদেশি বিনিয়োগ চাই তেমনি আমাদের যারা প্রবাসী আছেন তাদের বিনিয়োগও আমরা পেতে চাই। এ ছাড়াও কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা আছে এবং তা কীভাবে বাংলাদেশ পূরণ করতে পারে সে বিষয় নজর দেওয়া এবং রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া। বিভিন্ন দেশে চাহিদা থাকা পণ্যগুলো যেমন খুঁজে বের করা সম্ভব, তেমন সেই পণ্যগুলোর মধ্যে কী কী আমরা উৎপাদন করতে পারি বা রফতানি করতে পারি, সেটাও জানা সম্ভব এই দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে। শুধু গার্মেন্টস নয়, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া এবং খুঁজে দেখা দরকার যে, কোন দেশে কী ধরনের পণ্যে চাহিদার আছে এবং আমরা কীভাবে তা পূরণ করতে পারি।

আমাদের রফতানির সুযোগ বাড়ানো এবং প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো সম্ভব তার উপরও গুরুত্ব দিয়ে দূতাবাসগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের ডিজিটাল ডিভাইস, ওষুধ, টেক্সটাইল পণ্যসমূহ যা নিজেরা তৈরি করছি তা কীভাবে বিশ্বের বাজারে উপস্থাপন করা যেতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া এবং সুযোগ সুবিধা বের করে দেশের উৎপাদনে সাহায্য করা, সেটাও দূতাবাসসমূহের কাজ বলে মনে করি।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এবং তাদের সম্পর্কে খবরাখবর রাখাটাও বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসগুলোর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার কথা।

আমরা সারাক্ষণ দেশের সমস্যার মধ্যে ডুবে আছি। এদিকে আমাদের অনেক দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে সেদিকেও তো খেয়াল রাখা দরকার। সবকিছুই যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয় তাহলে হবে কি বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করা সম্ভব? হবে না।

আমার বিশ্বাস কুটনীতিকরা দেশের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। তাদের বর্তমান পারফরমেন্স আশাব্যঞ্জক নয়, আমি মনে করি তাঁরা আরো ভালো করতে পারে বাংলাদেশের উন্নতির জন্য। শুধু সরকারদলীয় প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক নয় বরং দলনিরপেক্ষ সম্পর্ক তৈরি করে দেশের যৌথ উন্নতির জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া আশু প্রয়োজন।

আমি আমার তিন যুগের বেশি সময় বাইরে রয়েছি। যতোটুকু জেনেছি দেশের অন্ন শুধু দেশে নয় সেটা দেশের বাইরেও ধ্বংস হচ্ছে। দেশের সচিবালয়েও খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার কী হচ্ছে সেখানে। একই সাথে দেশের বাইরে যারা কর্মরত তাদের খোঁজ খবরও জনগণের রাখা দরকার। জনগণ দেশের মালিক অথচ মালিক জানেনা কে কোথায় কী করছে বা কীভাবে চলছে সবকিছু। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যেনো সব হাওয়ালে বৃন্দাবন। সব আনাড়ি খেলোয়াড়দের ফুটবল খেলা।

জনগণ যদি সচেতন না হয় তবে আমলারা তাদের মতো করেই চলবে। আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য হওয়া দরকার যারা সরকারি কর্মে কর্মরত, তাদের কাজের পারফর্মেন্স বুঝে নেওয়া। জনগণের প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেশের আইন প্রণয়ন করা। এখন যদি তাঁরা সারাক্ষণ মাননীয় শম্ভু এমপির মতো তাঁর ছেলেকে নিয়ে বা নয়ন বন্ডের ঝামেলায় জড়িয়ে থাকে তাহলে তো দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি স্বাধীন দেশকে তো আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারিনা! মালিককে জানতে হবে কী করছে তার কর্মীরা।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন