আজ এই মুহুর্তে হঠাৎ সুইডেনের আকাশে বজ্রপাত শুরু হয়েছে, প্রচন্ড শিলা বৃষ্টি হয়ে এদের ফসলের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে- এটা একটা গুজব। কারণ এখন ওয়েদার চমৎকার, সূর্য দেখা যাচ্ছে। সুইডেনে এখন রাত ১০টা বাজে অথচ সূর্য কীরণ দিচ্ছে, এখন গ্রীষ্ম কাল তাই।কিন্তু শীতে কখনও এমনটি হয়না। আমি এখন যা জানালাম তা গুজব নয়, এটা একটা সত্য ঘটনা।  আমি আজ গুজব সম্মন্ধে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই যাতে করে গুজবের কারনে আমরা আমাদের সত্য মিথ্যার ভারসাম্ম্য একেবারে হারিয়ে না ফেলি।

গুজব রটানো, কথা চালানো, কথা লাগানো, কথাকে পরিবর্তন করা বা গুজবের উপর ভিত্তি করে শেয়ার বাজারের বেচা কেনা করা হচ্ছে মানব জাতির এক চির প্রচলিত স্বভাব। যা হয়ে আসছে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে। তিলকে তাল করা বা কিছু রটেছে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরেক রকম করে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষ জাতির একটি খাসলত। প্রযুক্তির কারণে গুজবের ধরণ এবং তা দ্রুতগতিতে ছড়ানো যেমন বেড়েছে বেশি, তেমন এর পরিমানও বেড়েছে প্রচুর। যা কিছুই ঘটছে সঙ্গে সঙ্গে তা রটছে, সত্য মিথ্যার যাচাই বাছাই ছাড়া। সব গুজবই যে মানব কল্যানে ক্ষতিকর তা নয়, তবে বেশির ভাগ গুজবই নেগেটিভ ভাবে প্রভাব বিস্তার করছে বর্তমান যুগে।

ইউরোপ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে গুজব কেমন ধরনের এবং কী কী প্রতিক্রিয়া লক্ষনীয়? এখানে লোকের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে এবং খবরের মাধ্যমে নানা বিষয়ের উপর গুজব ছড়ায়। সুইডেনে আমার কর্রস্থলে এক সহকর্মী ছিল, বয়স হবে ২২-২৩ বছর। সে বেশ গুজব রটাতে এবং মেয়ে পটাতে ছিল পাকা। আমরা সবাই তার সমবয়সী বিধায় স্বাভাবিক ভাবে তার মেয়ে পটানোর কায়দা কানুন দেখে বেশ আপ্লুত হই। সে যাই বলে আমরা তাই বিশ্বাস করি। যেমন নতুন কোন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় এবং কিভাবে পরিচয় হলো সবই সে সুন্দর করে আমাদের বলে। দেখা গেলো সে আমাকে এক ভাবে বর্ণনা করেছে, পরে একই ঘটনা এক এক করে সবাইকে বলেছে তবে ভিন্ন ভাবে। তার একটাই অনুরোধ ছিল তা হলো সে যা আমাকে বলেছে অন্য কেও যেনো তা না জানে। তার ভাবভঙ্গি এমন যে সে শুধু আমাকেই তার সব কিছু শেয়ার করেছে। কোন এক সময় ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে এবং জানা যায় যে সে সবাইকে একই ঘটনা বলেছে তবে কিছুটা পরিবর্তন করে, যার কারনে পরবর্তীতে আমরা কেউ তাকে আর বিশ্বাস করতে পারিনি।

অনেকে লিখার মাধ্যমে গুজব ছড়ায়। যেমন শেয়ার মার্কেটের খবরে অনেক সময় ভুল তথ্য দেয়া হয়ে থাকে। যার কারনে শেয়ার বাজারের বেচা কেনাকে গ্যাম্বলিং বলা হয়ে থাকে। আবার কেও কোন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে এনেছে দেখা গেলো সত্যি মিথ্যা প্রচার করে প্রোডাক্টের দাম উঠা নামা করাতে সাহায্য করে। কিছু কিছু খবর যেমন আকষ্মিক ভাবে প্রচার করা হয় যেমন কোথাও দুর্ঘটনা ঘটেছে, বেশ ক্ষয়খতি হয়েছে, সুক্ষ তদন্ত ছাড়াই বড় করে গুজব রটিয়ে দেয়া হয়। গুজবের ধরণ ইউরোপ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে বলতে গেলে একই রকমের। গুজব অতীতে ছিলো বর্তমানে আছে ভবিষ্যতে থাকবে।

অনেকেই কথাটির সাথে পরিচিত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ বা A little knowledge is a dangerous thing. কথাটির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে যোগাযোগের মাধ্যম বেড়েছে। লোক মুখে, সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যার যা খুশি লিখার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা দেদারছে যার যা খুশি লিখছি। এখন প্রশ্ন, মুখে কিছু বলা এবং সে কথার পরিবর্তন গুজবের মাধ্যমে নানা ভাবে ছড়াতে পারে। কিন্তু যখনই কিছু লিখা হয় তখন সেটা ডকুমেন্ট হয়ে যায় এবং লিখিত ডকুমেন্ট দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন লিখিত তথ্য যদি সঠিক না হয় এবং তথ্যের সত্যতা না থাকে, এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’।

আমাদের মুখের কথা যখন লিখার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং যদি পরে দেখা যায় যে লিখার সত্যতা দুর্বল, তখন ব্যক্তির কথার দুর্বলতা, ব্যক্তির চরিত্রের দুর্বলতার উপর প্রশ্ন আসে। এ ক্ষেত্রে গুজব সমাজ বা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা কোন কিছু লিখা বা বলার আগে যদি ১০০% নিশ্চিত না হই, সে ক্ষেত্রে লেখা বা বলার শুরুটা হওয়া উচিত যেমন আমি যতটুকু জেনেছি বা শুনেছি ইত্যাদি। কিন্ত যদি বলি আমি যা দেখেছি এ ক্ষেত্রে দেখার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া মানে সত্যকে তুলে ধরা। নিজের চোখে দেখা ঘটনা বিশ্বাস করা যত সহজ তত সহজ নয় যদি বলা হয় আমি যতটুকু শুনেছি বা জেনেছি।

সুইডিশরা এদের কথা বার্তায় পুরোপুরি শিওর না হয়ে সাধারণত কিছু বলতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশে গুজব ছড়াতে আমরা বেশ পন্ডিত। আমি মনে করি আমাদের আচরণ এমন হওয়া উচিত যেনো কিছু লিখার আগে স্টেটমেন্ট দেই যেমন আমার মতে, আমার বিশ্বাস, আমার ধারনা, আমি শুনেছি, আমি দেখেছি, আমি পড়েছি বা আমার ব্যক্তিগত অভিমত ইত্যাদি। তাহলে গুজবের ধরণ বর্তমানের চেয়ে আলাদা হবে এবং যা হয়ত সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে না, যা করছে বর্তমানে। মনে রাখা দরকার ময়লা নাড়ালে গন্ধ ছড়ায় বেশি তাই গুজব সমাজের জন্য কখনও ভালো কিছু দিতে পারেনি, পারবেও না।

বহু পুরনো দিনের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল।
“একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে, ভুল করেছেন যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে। একটু খানি ছোট্ট শিশুর একটু মুখের হাসি, মায়ের কানে সবার প্রানে বাজায় সুখের বাঁশি”। ভুলের কারনে অনেক কিছুই ঘটে, তাইতো ঘটে গেল কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। মা তাঁর ছোট্ট শিশুকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। স্কুলে ঢুকতেই তাকে সন্দেহ করে গনপিটুনি দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। –

এদিকে ছেলে ধরা এবং গলা কাটা বা শিশুর মাথা ব্যাগের ভেতর থেকে উদ্ধার করতে দেখা গেছে যা গুজব নয়। আবার ডেঙ্গুজ্বরে মানুষ মরছে এ খবরও গুজব নয়। তবে মাথা লাগবে পদ্মাসেতু তৈরি করতে এটা গুজব।
বাংলাদেশে বর্তমানে সত্য এবং মিথ্যার সমন্বয় ঘটে চলেছে ভয়ংকর ভাবে। এর থেকে রেহাই পেতে অবশ্যই দরকার সবার সচেতনতার। সবার উচিত তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড সঙ্গে রাখা, গণপিটুনির হাত থেকে রেহাযই পেতে এবং সর্বোপরি যাচাই বাছাই না করে, সত্য ঘটনা না জেনে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে বা গুজবের কারনে, ভুল সিদ্ধান্তে, কারো জীবনে অন্ধকার যেনো না নেমে আসে, সে দিকে খেয়াল রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।

– ‘ভুলের কারনে বিনা অপরাধে পিটিয়ে তোমরা মারিলে আমাকে তোমাদের দুহাত দিয়ে। আমার মাথাটা কেটে নিলে তুমি ঐ ধারালো অস্ত্র দিয়ে। আমার জীবনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন তাও তুমি নিলে কেড়ে। যে ভালোবাসা রয়েছে হৃদয়ে, দেখিতে যদি তুমি পারিতে, কখনও তুমি মারিতে না মোরে, তোমার দুহাত দিয়ে’।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন