প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ইতালি। গত ৬ মার্চ দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ হাজারের মতো, মারা গিয়েছিল ১৪৮ জন। কিন্তু তখনো ইতালির বেশির ভাগ মানুষ একে গুরুত্ব দেয়নি। এর পরিবর্তে তারা মেতেছিল নানা গুজব আর ভুয়া খবরে।

তবে, এক মাস না গড়াতেই ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে এখন ১০ হাজার ছাড়িয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যাও লাখ ছুঁতে যাচ্ছে। এখনকার পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই মাসের শুরুতেও নানা গুজব ও ভুয়া খবরের পেছনে কেমন ছুটছিলেন ইতালীয়রা।

করোনাভাইরাসের শুরুর দিকে প্রায় গোটা উত্তর ইতালিকে সরকার কোয়ারেন্টিনে পাঠালেও নগরবাসীদের তা মানাতে বেগ পেতে হয়েছিল প্রশাসনের। ওই সময় সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ঘটনা এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে, যা ছিল পুরোপুরি ভুয়া।

সেনা মোতায়েনের ভুয়া খবর

এই মাসের প্রথম দিকে ইতালির রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখা যাচ্ছে এমন একটি ভিডিও টুইটারে পোস্ট করার পর সেটি আড়াই লাখ বার দেখা হয়েছিল। ভিডিওতে প্রথমে বলা হয়েছিল, এসব গাড়ি দক্ষিণাঞ্চলীয় ফজজা শহরে, পরে সংশোধন করে বলা হয় সিসিলির পালেরমোতে।

আরও বলা হয়, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কারাগারে দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর কারাগারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ওইসব গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে।

ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পালেরমোর রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো ছিল সেটা সত্য, কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে কারাগারে অস্থিরতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ষষ্ঠ ল্যানসিয়েরি দি আওস্টা রেজিমেন্টের ওই যানগুলো সার্দিনিয়ায় সামরিক মহড়া শেষে ফিরছিল এবং সেগুলোর সঙ্গে কারাগারে অস্থিরতা বা করোনাভাইরাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।

টিকা কিনতে পারার ভুয়া খবর

ভেনিসের একটি এলাকার দোকান ও বাড়ি বাড়িতে একটি লিফলেট ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে অস্ট্রেলিয়ায় টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ড তা কিনেছে।

লিফলেটে আরও বলা হয়, ভ্যাকসিনের ছয়টি ডোজ নিলে এক বছরের জন্য করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে এবং মাত্র ৫০ ইউরোয় সেটি পাওয়া যাবে। যোগাযোগের জন্য একটি ইমেইল অ্যাড্রেসও দেওয়া হয়েছিল সেখানে।

তবে প্রকৃত বাস্তবতা হল বিশ্বে এখননো করোনাভাইরাসের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ তা হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশকারী একটি ইতালিয়ান সাইট বলেছিল, ‘টিকার অস্তিত্ব নেই। তবে যেটা আছে সেটা হলো- মিথ্যা বলে লোকজন মজা নিচ্ছে।’

লেবুর শরবত

করোনাভাইরাস মোকাবিলার নানা টোটকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল-চীনের জানজান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলেছেন, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে তুমি যত বেশি পার ভিটামিন সি খাও। ভাইরালম্যাগাজিন ডট আইটি নামে একটি নিউজ পোর্টালে এটা প্রকাশিত হওয়ার সেটির ভিউ হয়েছিল ৫ লাখ ৭৬ হাজার, আর্টিকেলটি শেয়ার হয়েছিল ৩০ হাজার ।

ওই পোস্টে ‘প্রফেসর চেন হোরিন সিইও অফ দ্য বেইজিং মিলিটারি হসপিটাল’কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে, লেবুর রস মিশ্রিত গরম পানীয় করোনাভাইরাসের বিস্তার কমাতে পারে।

তবে ওই পোস্টের অনেক কিছুই সঠিক ছিল না বলে বিবিসি দেখিয়েছে-

চীনা ওই গবেষক ভুয়া বলে মনে হয়। কারণ তার নাম ইংরেজি অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘হোয়াট ইজ ইওর নেইম (তোমার নাম কি)’। চীনে জানজান বিশ্ববিদ্যালয় বলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর আগে ক্যানসার নিয়ে ভুয়া পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ওই প্রফেসরের কথা বলা হয়েছিল। তা ছাড়া লেবুর শরবত বা প্রচুর ভিটামিন সি এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে তা এখননো প্রমাণিত নয়।

হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ ছড়িয়ে পড়ে লোকজনকে জীবাণুনাশক দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া ও গার্গল করার পরামর্শ দিয়ে। সেখানে বলা হয়, ভাইরাস যাতে ফুসফুসে যেতে না পারে সেজন্য গার্গল করতে হবে। তবে ঘন ঘন হাত ধোয়া উপকারী হলেও গার্গল করা কোনো কাজে দেয় বলে জানা যায়নি।