মৃত্যু, আক্রান্ত, ঝুঁকি, আতঙ্ক-সব কিছুই দ্রুত বাড়ছে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায়। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরের পর মারাত্মক করোনা ঝুঁকিতে এই বিভাগ। এ অবস্থায় জামালপুর ও নেত্রকোনায় পিসিআর ল্যাব স্থাপনের দাবি জানিয়েছে সচেতন মহল। চার জেলায় ১ হাজার ৩৬০ জন চিকিৎসক এবং ১ হাজার ৪১৫ জন নার্স রয়েছেন। তাদের অনেকে করোনা চিকিৎসার গাইডলাইন ও অনলাইনের মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

ফুলপুরের করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তি গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার লাশ স্বজনরা এলাকায় নেননি। ময়মনসিংহের মেয়র ইকরামুল হক টিটুর নির্দেশে বিশেষ ব্যবস্থায় নগরীর ভাটিকাশর কবরস্থানে শুক্রবার দুপুরে লাশটি দাফন করা হয়। জামালপুরে করোনার উপসর্গ নিয়ে দুই ব্যক্তি মারা যান। মৃত্যুর পর নমুনা পরীক্ষায় তাদের করোনার পজিটিভ ধরা পড়ে।

এ ছাড়া গত ১৬ দিনে এই বিভাগের চার জেলায় ৬০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ জন আইসোলেশন ইউনিটে এবং ১৬ জন হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৩ চিকিৎসক, ৫ নার্স ও ১৭ স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবে এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৫৮ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও নানা পথে করোনা উপদ্রুত এলাকা নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুর থেকে শ্রমজীবী মানুষ ছুটে আসছে নিজ নিজ বাড়িতে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে করোনা রোগী। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিনরাত আপ্রাণ চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারছে না এসব শ্রমজীবীর আগমন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনকে উপেক্ষা করে ভালুকা উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ছাড়াও কাচিনা ইউনিয়নের শৈলাটি, মল্লিকবাড়ির গৌরীপুর, রাজৈ ইউনিয়নের পারুলিদিয়া, উড়াহাটি, ঝালোপাড়া এবং বিরুনিয়া ইউনিয়নের স্কুলের বাজার এলাকা দিয়ে নানাভাবে সড়কপথে ও নদী অতিক্রম করে মানুষ ময়মনসিংহ জেলায় প্রবেশ করছেন।

এ ছাড়াও গফরগাঁও উপজেলার গয়েশপুর, ত্রিমোহিনী, টোক-বরমী, বারইহাটি, সুতারচাপুর, চাকুয়া এলাকা দিয়ে নানাভাবে সড়কপথ ও নদী অতিক্রম করে মানুষ ময়মনসিংহ জেলায় প্রবেশ করছে। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বড় বড় সড়কে পুলিশের কড়া চেকপোস্ট থাকায় বিকল্প পথে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করছে অন্য জেলায় এতদিন কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার খোন্দাকার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, করোনা ঝুঁকি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলাকে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে এই প্রথম ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের বিশেষ উদ্যোগে ১১ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত মোবাইল কোর্টে ১৬টি মামলায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যারা অন্য জেলা থেকে এই বিভাগের প্রবেশ করছে, তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার এবং সব মানুষকে ঘরে থাকার লক্ষ্যে মাইকিং, লিফলেটসহ নানাভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। দুস্থদের জন্য দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সহায়তা। এ ছাড়া ওএমএসের চাল ও নগদ অর্থ অন্যান্য সহতায়তা চুরির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে প্রশাসন। দুদকে মামলা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. চিত্তরঞ্জন দেবনাথ জানান, কলেজে মোট ২৪৩ জন শিক্ষক-চিকিৎসক রয়েছেন। হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. লক্ষ্মীনারায়ণ মজুমদার জানান, এই হাসপাতালে ৩০৮ জন চিকিৎসক, ১১৭ জন ইন্টার্ন এবং ৬৫৯ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য ডা. মো. আবুল কাশেম জানান, বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলায় মোট আইসোলেশন বেডের সংখ্যা ১ হাজার ১৮টি, ভেন্টিলেটর সরকারি ৭টি এবং বেসরকারি ৫টি। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বেড রয়েছে ৩৩০টি। পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও করোনা পরীক্ষার কিটও রয়েছে পর্যাপ্ত।

এ ছাড়া এই বিভাগের করোনা রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তার ও নার্সরা অনলাইনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিভাগের চার জেলায় ৬৯২ জন চিকিৎসক এবং ৭৫৬ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন।

ময়মনসিংহ বিভাগ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান বলেন, বিভাগের চার জেলাকে একেবারে সিল করে দেওয়া হোক; নামেমাত্র নয়, কার্যকর লকডাউন করার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে জামালপুর ও নেত্রকোনা মেডিক্যাল কলেজে আরও দুটি করোনা ভাইরাস শনাক্তের পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অনুরোধ জানান তিনি।