গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে নয়টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে। গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জেব্রাগুলো মারা যায়। এর মধ্যে ৪টি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ইনজুরির কারণে এবং অপর ৫টি জেব্রা ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের (ইনফেকশনাল ডিজিজে) কারণে মারা গেছে। নেতিবাচক পরিস্থিতির কথা ভেবে পার্ক কর্তৃপক্ষ তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি। মঙ্গলবার বিকেলে পার্কের ঐরাবতী বিশ্রামাগার মিলনায়তনে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন এ সংক্রান্ত গঠিত বিশেষজ্ঞ বিশেষ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য, জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ও প্রাক্তন চীফ ভেটেরিনারী অফিসার ডা. এবিএম শহীদুল্লাহ।

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে জেব্রার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ নির্দেশ দেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান।

পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বনসংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান জানান, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ৩১টি জেব্রা ছিল। গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পার্কের আফ্রিকান কোর সাফারির জেব্রা বেষ্টনীতে পর্যায়ক্রমে মোট ৯টি জেব্রার মৃত্যু হয়। নয়টি জেব্রা মৃত্যুর পর এখন পার্কে জেব্রার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২টিতে। মৃত জেব্রাগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয় এবং সেগুলোর দেহের নমুনা সংগ্রহ করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। সোমবার রাতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে পার্কের এক তৃতীয়াংশ জেব্রার মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে নমূনা পরীক্ষার ফলাফল হাতে নিয়েই একটি বিশেষজ্ঞদল মঙ্গলবার পার্কে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে বিশেষজ্ঞরা এসব রিপোর্টের আলোকে জেব্রাগুলোর মৃত্যুর কারন ব্যাখ্যা করেন।

বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন, জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডাঃ এবিএম শহীদ উল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নুর আলী খান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারী অনুষদের সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃএসএম উকিল উদ্দিন ও সাফারী পার্কের ভেটেরিনারী অফিসার ডাঃ হাতেম সাজ্জাত জুলকারনাইন। এছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির।

বিশেষজ্ঞ বিশেষ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এবিএম শহীদুল্লাহ বৈঠক শেষে জানান, হঠাৎ করে জেব্রাগুলোর গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং শ^াসকষ্টসহ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেওয়ার ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে জেব্রাগুলো মারা গেছে। মারামারি করে জেব্রার মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি জানান, পুরুষ জেব্রাগুলোর মধ্যে কোন্টি আগে প্রজনন করবে সেজন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। চিড়িয়াখানা বা সাফারী পার্কেও এরকম ঘটনা ঘটে থাকে, এটি নতুন নয়। পার্কে এ মুহূর্তে ৮টি গর্ভবতী জেব্রা নিবিড় পর্যবেক্ষনে রয়েছে। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে মাদী ৭টি ও ২টি পুরুষ। পার্কে বর্তমানে জেব্রা রয়েছে মোট ২২টি। এরমধ্যে ৭টি মাদী ও ১৪টি পুরুষ জেব্রা রয়েছে।

জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডাঃ এ বিএম শহীদ উল্লাহ বলেন, সুদুর মানিকগঞ্জ থেকে ঘাস এনে জেব্রার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। সেখানকার ঘাসও পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাই বর্তমানে অবশিষ্ট যে প্রাণীগুলো সাফারী পার্কে রয়েছে তাদের সুস্থতায় বেশ কিছু পর্যবেক্ষন দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি বাকী প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারবো। ইতোমধ্যে জেব্রার নিরাপদ আবাসনের জন্য মোট ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষনগুলো হচ্ছে, জেব্রাগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে। আপাততঃ যেখান থেকে ঘাস দেওয়া হতো সেখান থেকে ঘাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। জেব্রার বসতির জায়গার মাটি ওলট পালট করে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জীবানু ধ্বংস করতে হবে, সাফারী পার্কের জলাধারের পানি পরিবর্তন করতে হবে, জেব্রাগুলোকে টিকার আওতায় আনতে হবে, জেব্রার খাবার হিসেবে পরিপক্ক ঘাসের ব্যবস্থা করতে হবে, শুকনা খাবার ফাঙ্গাসমুক্ত করে পরিবেশন করতে হবে, ঘাস পানিতে ভালো করে ধৌত করে কেটে টুকরো করে পাত্রে পরিবেশন করতে হবে, এসব প্রাণী বেস্টনীতে বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে, পার্কের অভ্যন্তরে পতিত জমিতে ঘাস উৎপাদন করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, নাইট ভিশন ক্যামেরা সহ পুরো বেস্টনীতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাকী প্রাণীগুলোকেও নজরদারী করা হচ্ছে। তাদেরকে খাবারের সঙ্গে নিয়মিত এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিদিন মল সহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।

সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির বলেন, সাফারি পার্কে চিকিৎসক ও জনবল কম। প্রাণি চিকিৎসায় পাঁচজনের একটি সেট আপের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তা থেকেই মেডিক্যাল বোর্ড উল্লেখিত কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন।

সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, পরীক্ষাগারে নমূনা পরীক্ষার পর মৃত জেব্রার একেকটিতে ব্যাকটেরিয়া ও করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ও খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ নানা বিষয়ের প্রমান মিলেছে। তবে আইসিডিডিআরবি ল্যাব থেকে করোনা নেগেটিভ এসেছে। সাফারি পার্কের মতো এমন জাত ও সংখ্যাধিক্য জেব্রা দেশের কোথাও নেই। আগে জেব্রার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে জেব্রার গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, শ^াসকষ্ট হচ্ছে এবং এসব উপসর্গ দেখা যাওয়ার ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে জেব্রা মারা যাচ্ছে। ২ জানুয়ারি থেকে জেব্রা মারা যায়। কয়েকটি অসুস্থ্য জেব্রাকে চিকিৎসা দেওয়ার পর সুস্থও হয়েছে। হঠাৎ করে এভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যু খুবই কষ্টকর। নিজের হাতে লালন পালনের পর চোখের সামনেই এদের মৃত্যু দেখতে হলো। এখানে আমাদের কারো কোন ধরনের গাফিলতি ছিল না।

তিনি বলেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ঘাস ধুয়ে জেব্রাগুলোকে খাওয়ানো হচ্ছে। তারপরও কয়েকটি জেব্রা মারা গেছে। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাদী জেব্রা অর্থাৎ ৯০ভাগই মাদী জেব্রা। এ পার্কে জন্ম নেয়া জেব্রাগুলোর মৃত্যু বেশি হয়েছে। পার্কের ৯টি জেব্রা মারা যাওয়ার পর অবশিষ্ট ২২টির মধ্যে ৮টি জেব্রা গর্ভবতী। এগুলোর মধ্যে কোনো ধরণের সংক্রমণ হয় কি না তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। তিনি দাবী করে বলেন, পার্ক কর্তৃপক্ষের কোনোরূপ অবহেলা নেই। এ পার্কে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রাণিগুলোর পরিচর্যা করা হয়। পার্কের নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। বাইরে থেকে কেউ এসে বিষ প্রয়োগের সুযোগও নেই। মঙ্গলবারের বৈঠকের পর পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সতর্কতামূলক বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রকল্প পরিচালক মো: জাহিদুল কবির জানান, জেব্রা দলবেঁধে চলে। পার্কে জেব্রাগুলোর মৃত্যুর আগ থেকে এদের মৃত্যুর কোন রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। প্রাণীগুলো বন্য এদের কাছে যাওয়া যায় না। মৃত্যুর আগে হঠাৎ দল থেকে আলাদা হয়ে যায় জেব্রাগুলো। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং পেট ফুলে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। করোনা সন্দেহে পিসিআর ল্যাবে মৃত জেব্রাগুলোর নমুনা পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্টগুলো নেগেটিভ এসেছে। এছাড়াও খাবারে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে এমন সন্দেহে খাবারগুলোও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। মৃত জেব্রাগুলোর ফুসফুস, লিভার, মৃত্যুর পর পেটে থাকা অর্ধগলিত খাবারের নমূনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে, যার রিপোর্ট চলে এসেছে। তিনি আরো বলেন, সাফারি পার্কের বিশাল এলাকাজুড়ে জেব্রার বসতি। জেব্রার চারণভূমিতে রয়েছে কৃত্তিম লেক ও চারণ ভূমি। উন্মুক্ত অবস্থায় বিচরন করে জেব্রা। তাদের সঙেঙ্গ অন্যান্য প্রাণীরও বিচরন রয়েছে। জেব্রাগুলো যে খাবার খাচ্ছে, তা পার্কে থাকা অন্যান্য প্রাণীগুলোও খাচ্ছে। খাদ্যে বিষয়ক্রিয়ায় মৃত্যু হয়ে অন্যান্য প্রাণীগুলোরও মৃত্যু হতে পারতো।
পার্কসুত্র জানায়, পার্কের যাত্রা শুরুর প্রথম থেকেই জেব্রা পালে নতুন অতিথির সংখ্যা যুক্ত হচ্ছিল। গত কয়েক বছর যাবত বিশেষ করে করোনা সময়ে জেব্রার অধিকতর প্রজনন ঘটে। যেভাবে জেব্রার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে কর্তৃপক্ষ অনেক আশাবাদী ছিলেন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে জেব্রা বিদেশেও রপ্তানীর একটা সম্ভাবনা ছিল। পার্কের অন্যসব প্রাণীর মধ্যে জেব্রার প্রজনন ছিল আশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন সময় জেব্রার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে মৃত্যুর কারণগুলো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ২ জানুয়ারি থেকে পার্কে জেব্রা মৃত্যু হলেও পার্ক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গোপন করে রেখেছিল। সবশেষ সোমবার রাতে পার্কে জেব্রার মৃত্যু বিষয়টি প্রকাশ পায়। পার্কে সবশেষ পার্কে ৩১টি বেশি জেব্রা ছিল।