গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে জানুয়ারি মাসে ১১টি জেব্রা ও একটি বাঘ মৃত্যুর ঘটনায় ওই পার্কের দুই কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়ার পর ওই দুই পদে নতুন কর্মকর্তা যোগদান করেছেন। বুধবার সকালে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম এবং ভেটেরিনারী সার্জন পদের ডা. মোস্তাফিজুর রহমান নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তারা দায়িত্ব বুঝে নিয়ে সাফারি পার্ক এলাকা পরিদর্শণ করেন ও খোঁজখবর নেন। এসময় তারা পার্কে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে জানুয়ারি মাসে ১১টি জেব্রা ও ১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। জেব্রা ও বাঘের মৃত্যু কারণ জানতে ইতোমধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত কাজ সঠিক ভাবে করতেই এ পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান ও সাফারী পার্কের ভেটেরিনারী সার্জন ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকারনাইনকে বন অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। তারা স্বপদে বহাল থাকলে তদন্ত সুষ্ঠু হবে না। এ ব্যাপারে গত ৩১ জানুয়ারি একটি অফিস আদেশ জারী করা হয়। ওই আদেশে তবিবুর রহমানের স্থলে ফরিদপুর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলামকে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকারনাইনের স্থলে কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা এলাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ভেটেরিনারী সার্জন ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

সূত্রে জানাগেছে, গত জানুয়ারি মাসে ২৭ দিনের ব্যবধানে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ১১টি জেব্রা ও একটি বাঘের মৃত্যুর ঘটনায় পার্কে কর্মরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও ভেটেরিনারী সার্জন ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকারনাইনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে চরম অবহেলার অভিযোগ উঠে। পার্কে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ, সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে প্রাণীর খাবার পাচার, জেব্রা ও বাঘ মৃত্যুর ঘটনা গোপন রাখা এবং জেব্রাগুলোকে হত্যার অভিযোগ এনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ সহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উঠে। এরপ্রেক্ষিতে ওই দুই কর্মকর্তাকে পার্কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির জানান, গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে পার্কের ৩১টি জেব্রার মধ্যে ১১টি জেব্রা পর্যায়ক্রমে মারা যায়। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাদী জেব্রা। এ পার্কে জন্ম নেয়া জেব্রাগুলোর মৃত্যু বেশি হয়েছে। এদিকে গত ১২ জানুয়ারি পার্কের ১০টি বাঘের মধ্যে একটি পুরুষ বাঘ হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর কারণ জানতে মৃত জেব্রা ও বাঘের শরীরের নমূনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ল্যাবে পাঠানো হয়। বাঘটি এনথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য মিলেছে। জেব্রার মৃত্যুপ্রতিরোধে জরুরী চিকিৎসা এবং এ ধরনের অসুস্থতার কারণ উদঘাটনে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা ১০দফা সুপারিশ দিয়েছে। এদিকে জেব্রাগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং করণীয় বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।

তিনি জানান, জেব্রা মৃত্যুর কারণ বিশেষজ্ঞরা এখনো সুনির্দিষ্ট করতে না পারলেও তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষজ্ঞ কমিটি জেব্রাগুলোর মৃত্যুর প্রাথমিক কয়েকটি কারণ নির্ধারন করেছেন। এতে প্রাণিদের মধ্যে মারামারি এবং পানিতে ও মাটিতে থাকা চার রকমের ব্যাকটেরিয়ার মিক্স ইনফেকশনের কথা বলা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেস্টে নিউমোনিয়ার সিমটম আসছে। ২৫ জানুয়ারির মধ্যে মৃত ৯টি জেব্রার মধ্যে ৪টি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ইনজুরির কারণে এবং অপর ৫টি জেব্রা অতিরিক্ত কাঁচা ঘাস ছাড়াও স্ট্রেপ্টোকক্কাস, ই-কোলাই, কøস্টোডিয়াম, সালমোনিলা ও পাস্টুরেলা নামক ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের (ইনফেকশনাল ডিজিজে) কারণে মারা গেছে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ ২৮ জানুয়ারি দুইটি জেব্রার মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছে বিশেষজ্ঞ দল।

তিনি আরো জানান, পার্কের প্রাণীগুলোকে সরবরাহ করা খাবারগুলো মূলত ফিজিক্যাল এক্সমিনেশন করা হয়। কেমিক্যাল পরীক্ষার কোন ফ্যাসিলিটি নেই এখানে। তারপরেও খাবার গুলোর মধ্যে কোন কেমিক্যাল বা অন্যকোন কিছু আছে কি-না ল্যাবের ফলাফল পাওয়ার আগে তা বলা যাবে না।

নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্কের একাধিক ব্যক্তি জানান, পার্কের প্রাণীগুলোর খাবার কোন প্রকার ল্যাবটেষ্ট বা কেমিক্যাল টেস্ট না করেই প্রাণীগুলোকে খেতে দেওয়া হয়। এসব খাবার হাতে নিয়ে চোখে দেখেই এর মান যাচাই করা হয়। জেনেটিক কারণে জেব্রার প্রাণি গুলোর আলাদা পরিচর্যার প্রয়োজন থাকলেও সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ছিল এ ক্ষেত্রে।

পার্কের এক কর্মকর্তা জানান, পার্কের ভেতরে প্রচুর পরিমাণ বানর রয়েছে। বানরের প্র¯্রাব-পায়খানার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ও টিবি রোগ ছড়িয়ে থাকে। বানরগুলো যেখানে খায় সেখানেই মাঝে মধ্যে পায়খানা-প্র¯্রাব করে। কোর সাফারির ভেতরে উন্মুক্ত স্থানে জেব্রার খাবার দেওয়া হয়। একই জায়গায় খাবার খায় বানরের দল। একই জায়গায় বানর ও জেব্রা খাবার খাওয়ার কারণে বানরের দেহ থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে কিনা সেটাও দেখা হচ্ছে। কারণ আফ্রিকা থেকে আনা জেব্রা আর পার্কে জন্ম নেওয়া জেব্রাগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক হবে না। জেনেটিক্যালি দূর্বল প্রাণীগুলোকে খুব সহজে যেকোন ভাইরাস আক্রমন করতে পারবে। তবে তদন্তকারী দল ও নমূনা পরীক্ষার ফলাফল পেলেই পার্কে জেব্রার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।