বসতবাড়ির জমি লিখে না দেয়ায় ৮০ বছর বয়সী মাকে মারধর করে দুই হাত ভেঙ্গে দিয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তা ছেলে ও তার স্ত্রী। নির্যাতনের শিকার ওই মাকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার হাত, পা মাথাসহ শরীরের সমস্ত জায়গায় শুধুই আঘাতের চিহ্ন।

মাকে নির্যাতনকারী রাজীব আলী ডন

নির্যাতনের শিকার মা হাসপাতালের বেডে আঘাতের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছেলে রাজীব আলী ডনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। অভিযুক্ত ছেলে রাজীব আলী ডন ন্যাশনাল ব্যাংক নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী মোছা. খালেদা বেগম গৃহিণী।

নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার রাতে। দিনাজপুর শহরের বড়বন্দর নতুন পাড়া মহল্লায় ওই মায়ের নিজ বাড়িতে। নির্যাতনের শিকার মা রেজিয়া খাতুন প্রাইমারি স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা। তিনি বড়বন্দর নতুন পাড়া মহল্লার মৃত বাহার আলীর স্ত্রী। স্বামী বাহার আলীও দিনাজপুর জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

পায়ে আঘাতের চিহৃ

মামলা ভিকটিম এবং স্বজনদের দেয়া তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, মা রেজিয়া বেগমের দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। স্বামীও গত হয়েছেন অনেক আগে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে রাজীব আলী ডন ব্যাংক কর্মকর্তা। ছোট ছেলে ও বড় ছেলের রেখে যাওয়া এক সস্তানকে নিয়ে বড়বন্দর নতুন পাড়ায় বসবাস করেন তিনি। বেশ কিছুদিন থেকেই ছেলে রাজীব আলী ডন মায়ের কাছে বসতবাড়ির ১৬ শতাংশ জমি লিখে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মা তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক সময়ে ছেলের জেদাজেদি ও নির্যাতনের কারণে ৩ শতাংশ জমি লিখে দেন। কিন্তু ছেলে সম্পূর্ণ জমিই লিখে নেয়ার জেদ ছাড়েননি। বাকি জমি লিখে না দেয়ায় নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। গত ১৯ রমজান মাকে আবারও নির্যাতন করেন। সেদিন পরিবারের লোকজন ও পুলিশের সমঝোতায় ছাড় পান তিনি।

পরে ঈদের দিন রাত ৮টার সময় ছেলে রাজীব আলী ডন তার স্ত্রী খালেদা বেগমসহ মা রেজিয়া বেগমকে বাকি জমি লিখে দিতে চাপ সৃষ্টি করেন। এতে রাজি না হওয়ায় ছেলে ও তার স্ত্রী মিলে মাকে অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। যে লাঠির ওপর ভর করে তার মা চলাফেরা করেন, সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ও লোহার রড দিয়ে মাকে মারধর করেন এবং লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। মায়ের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তারা আঘাত করেননি। নির্যাতন সইতে না পেরে মা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেলে আবারও টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেন ছেলে ও তার স্ত্রী। এ সময় মায়ের দুই হাত ভেঙ্গে যায়। মাথায় আঘাত পান, পায়ে তৈরি হয় আঘাতের ক্ষত। ছেলের স্ত্রী খালেদা বেগম বুকের ওপর বসে গলা চেপে ধরেন। এ সময় বড় ছেলের রেখে যাওয়া সন্তান নাতি লিমান ফুফুদের খবর দিলে তারা এসে মাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে খবর পেয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন থিয়েটারে সামনে দুই হাতে প্লাষ্টার করার জন্য দুই মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় রেজিয়া বেগমকে। তার দুই হাত ফোলা। বাহুতে আঘাতের কারণে কালো দাগ পড়েছে। পায়েও কালসিরি দাগ। তার পিঠে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন। পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ঠিকভাবে হাঁটতে পারছেন না তিনি। তাকে যখন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তখন দুইজনের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্ট করেই চলতে হচ্ছে।

এ সময় রেজিয়া বেগমের ছোট মেয়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মোছা. সামসি জাহান বকুল বলেন, এর আগেও জমির জন্য আমার ভাই মাকে মারধর করেছে। আবারও আমার ভাই ও ভাবি আমার মাকে মারধর করে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই আবার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। এ সময় পুলিশ তাকে আটক করে। আমরা তার বিচার চাই।

আরেক মেয়ে আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, আমরা ভাইবোন সকলে শিক্ষিত। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার মাও সাবেক শিক্ষিকা। আমাদের পরিবারে এই ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মায়ের ওপর নির্যাতনকারী আমার ভাইয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে করে আর কোনো সন্তান মায়ের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন না করে।

অপারেশন থিয়েটারের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মা রেজিয়া বেগম বলেন, আমি বারবার আমার ছেলেকে বলছিলাম বাবা আমি তোমার মা আমাকে মারিস না। আমি বংশের সবচেয়ে বড় সন্তান। তোর বাবা কিংবা আমার বাবা ও পরিবারের কোনো লোকজন আমার গায়ে কখনও হাত তোলেনি। কিন্তু আমার ছেলে কোনো কথা না শুনেই আমাকে মারধর করে। ছেলের নির্যাতনে আমি হাসপাতালে আর যে ছেলেকে আদর-যত্ন করে মানুষ করেছি সেই ছেলে জেলে। বলেন দেখি এমনটি কি হয়? আমি দেশের প্রচলিত আইনে এই ঘটনায় ছেলের বিচার চাই। যাতে কোনো মা ছেলের দ্বারা নির্যাতনের শিকার না হয়।

দিনাজপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, ওই ছেলে থানায় এসেছিল মায়ের বিরুদ্ধে মামলা দিতে। কিন্তু পুলিশ মাকে মারধরের বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তাকে আটক করে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দিলে ওই মামলায় ছেলেকে আসামি করে আদালতে পাঠানো হয়। বিচারক তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।