বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ প্রেটিন সমৃদ্ধ উচ্চ ফলনশীল বোরো মৌসুমের দুইটি নতুন জাতের ধানের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বীজ বোর্ড। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১১তম সভায় ধানের জাতগুলো অনুমোদন করা হয়। এর ফলে ব্রি উদ্ভাবিত সর্বমোট ধানের জাতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৫টি।

নতুন জাত দুটো হলো ব্রি ধান ১০৭ এবং ব্রি ধান ১০৮। এদের মধ্যে প্রেটিনের পরিমান যথাক্রমে ১০.০২% এবং ৮.৮ %। ইতোপূর্বে এর পরিমান পাওয়া গেছে ৮ বা ৮.২% । একজন মানুষের প্রাত্যহিক যে প্রোটিনের চাহিদা রয়েছে, এ জাতের ধানের ভাত খেলে সিংহভাগ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে বলে জানিয়েছেন ব্রি’র মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর। খেটে খাওয়া অনেক মানুষ তাদের দেহের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে পারেনা। তাদের জন্য এ জাত দুইটি ভাতের সাথে প্রেটিনেরও যোগান দিতে পারবে।

ব্রি’র মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুল কাদের বলেন, একজন মানুষের দৈনিক প্রেটিনের চাহিদা হলো ৫৮ গ্রাম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে একজন মানুষ যদি গড়ে দৈনিক ৪০৫ গ্রাম এ জাতের চালের ভাত খায় তবে তার দেহের চাহিদার ৭০-৭৫ শতাংশ প্রোটিনের অভাব পূরণ হবে।

ব্রি ধান ১০৭
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, ব্রি ধান ১০৭, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন উফশী বালাম জাতের বোরো ধান। ব্রি ধান১০৭ এর পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০৩ সেমি। ব্রি ধান১০৭ এর গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন যা ব্রি ধান৫০ এর সমান। এর ডিগ পাতা প্রশস্ত, খাড়া ও লম্বা এবং পাতার রং সবুজ। প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ৮.১৯ টন, তবে এটি অনুকূল পরিবেশে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে হেক্টর প্রতি ৯.৫৭ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। পিভিটি পরীক্ষায় দশটি অঞ্চলে ব্রি ধান১০৭ এর ফলন চেক জাত ব্রি ধান৫০ এর চেয়ে প্রায় ১৭.৬৭% বেশী পাওয়া যায়। এ ধানের গুণগতমান ভালো অর্থাৎ চালের আকৃতি অতি লম্বা চিকন (৭.৬ মি.মি.)। এ ধানের চালে অ্যামাইলোজ এবং প্রোটিন এর পরিমাণ যথাক্রমে ২৯.১% এবং ১০.০২% এবং ভাত ঝরঝরে। ব্রি ধান১০৭ এর ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন ২৬.১ গ্রাম। এ ধানের দানার রং খড়ের মত এবং চাল অতি চিকন ও সাদা। উচ্চ ফলনশীল, অতি চিকন চাল ও ভাত ঝরঝরে হও্য়ায় বাংলাদেশের মানুষ এ জাতটি চাষাবাদে ব্যাপক আগ্রহী হবে বলে আশা করা যায় এবং ফলশ্রুতিতে ব্রি ধান১০৭ চাষে বাংলাদেশের সামগ্রিক ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

গবেষণা: ১০৭ জাতটির উদ্ভাবক হলেন ব্রি’র মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে কৃষকের মাঠ থেকে সংগ্রহ করে বিশুদ্ধ লাইন বাছাইকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়। ব্রি গাজীপুরের গবেষণা মাঠে নির্বাচিত কৌলিক সারিটি ৩ বছর সফল ফলন পরীক্ষণের পর ২০১৯ সালে ব্রি’র আঞ্চলিক কার্যালয় সমূহের গবেষণা মাঠে ও ২০২০ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। ২০২২ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী কর্তৃক স্থাপিত প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় (পিভিটি) সন্তোষজনক হওয়ায় জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দলের সুপারিশের ভিত্তিতে জাতটি ছাড়করণের জন্য আবেদন করা হয়। জাতীয় বীজ বোর্ডের সভায় সারা দেশে চাষের জন্য একটি প্রিমিয়াম কোয়ালিটির উচ্চ ফলনশীল বালাম জাতের বোরো ধান হিসাবে লতা বালাম ব্রি ধান ১০৭ হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।

ব্রিধান ১০৮
ব্রি ধান ১০৮ জাতটি বোরো মৌসুমে সারা দেশে চাষ উপযোগী। এই জাতের গ্রেইন টাইপ জিরা ধানের মতো। প্রতিটি ছড়ায় অধিক সংখ্যক ধান (২৫০-২৭০ টি) ঘনভাবে সন্নিবেশিত। ব্রি ধান১০৮ এর পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০২ সেমি, এর ডিগ পাতা খাড়া ও গাঢ় সবুজ, একই সাথে হেলে পড়া সহিষ্ণু এবং জীবনকাল ১৪৯-১৫১ দিন। এই জাতের গ্রেইন টাইপ জিরা ধানের মতো। জাতটি কৃষকদের ভালো বাজার মূল্য পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে উদ্ভাবন করা হয়ছে। ব্রি ধান১০৮ এ উচ্চ ফলন ও ফাইন গ্রেইন এর সমন্বয় ঘটেছে । এ জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি ছড়ায় অধিক সংখ্যক ধান (২৫০-২৭০ টি) ঘনভাবে সন্নিবেশিত এবং গড় ফলন ৮.৭ টন/হে যা ব্রি ধান১০০ জাতের চেয়ে ১.০-১.৫ টন/হে বেশী। ব্রি ধান১০৮ এর ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ১৬.৩ গ্রাম, চাল মাঝারি লম্বা ও চিকন যা জিরা চালের অনুরুপ, ভাত ঝরঝরে, রং সাদা এবং আ্যমাইলোজ ও প্রোটিনের পরিমাণ ২৪.৫% এবং ৮.৮ %।

গবেষণা: ১০৮ জাতটির উদ্ভাবক হলেন ব্রি’র মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম মাসুদুজ্জামান। তিনি বলেন, এ জাতটি ওজ ৮০৫৬১ এবং ঈযরহধ রহনৎবফ ৩২১ এর মধ্যে সংকরায়ণ পদ্ধতিতে বিআরএইচ১১-৯-১১-৪-৫বি উদ্ভাবিত হয়েছে। উক্ত কৌলিক সারিটির গবেষণা কার্যক্রম ব্রিতে ২০১২ সন থেকে শুরু হয়। এনএটিপি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি), গাজীপুর এবং ব্রির আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহের গবেষণা মাঠে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে নানা কৃষি পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে এই নতুন কৌলিক সারিটির উপযোগিতা, ফলন ও অন্যান্য কাংঙ্খিত বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপক ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১১ তম সভায় এ কৌলিক সারিটি ব্রি ধান১০৮ নামে বোরো মৌসুমে সারা দেশে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয় ।

মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১১তম সভায় ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।