রাজধানীর আজিমপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক মুরাদ হোসেনের হাতে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, স্কুলের পাশে কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের পড়ানোর নামে ভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়াসহ নানাভাবে যৌন হয়রানি করেছেন মুরাদ। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে তার মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে। ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের করা মামলায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কলাবাগান থেকে শিক্ষক মুরাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএমপি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মাহবুব-উজ-জামান, অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ও সহকারী কমিশনার ইমরান হোসেন মোল্লা।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, শিক্ষক মুরাদকে জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষক মুরাদের মোবাইল ও ল্যাপটপ থেকে বেশকিছু ভিডিও ও অডিও রেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মুরাদের বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আসছে। সবকিছু মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। এছাড়া মুরাদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার অনেক ছাত্রী মুখ খুলতে শুরু করেছে।

তিনি বলেন, ডিএমপির লালবাগ থানায় এক শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে শিক্ষক মুরাদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, তার মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আজিমপুর শাখার ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মুরাদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। কোচিং চলাকালীন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার সহপাঠীদের আপত্তিকর কৌতুক শোনাতেন শিক্ষক মুরাদ। ওই ছাত্রী স্কুলে নাচ করত, সেই নাচের ভিডিও শিক্ষক মুরাদ ঘুমানোর আগে দেখতেন। ২০২৩ সালের ১০ মার্চ বিকেলে সব শিক্ষার্থী চলে গেলেও তাকে কৌশলে বসিয়ে রাখেন মুরাদ। পরে পানি নিয়ে আসার আনার কথা বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে যৌন হয়রানি করে।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি কারও সঙ্গে না বলার অনুরোধ করে মুরাদ বলেন, ‘আমি তোমাকে বাবার মতো জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেছি, এটা কাউকে বলবে না।’ পরে সেসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভয় দেখাতেন। তিনি শিক্ষার্থীকে বলেন, এই ঘটনা জানাজানি হলে তোমার মা-বাবার সম্মানহানি হবে। এ ছাড়া স্কুল থেকে তোমাকে বের করে দেবে।’ মুরাদের এমন হুমকিতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিষয়টি গোপন রাখে।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন অশালীন আচরণের বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তারা উদ্যোগী হয়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবককে স্কুলে ডাকেন। পরে অভিভাবকদের উপস্থিতিতে শিক্ষক মুরাদের হাতে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে তারা বিষয়টি স্বীকার করেন। তার পর অনেক শিক্ষার্থী মুরাদের হাতে নির্যাতনের মুখ খুলতে শুরু করেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আজিমপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শিক্ষক মুরাদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন। পরে তারা প্রেসক্লাবের সামনেও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধ করেন।

এ ঘটনার পর অভিভাবক অনেকেই চিন্তিত। তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিভাকদের উদ্দেশে খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, নারী ও শিশুর বিষয়ে পুলিশ অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ যদি কেউ করে থাকে, তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। যেসব শিক্ষার্থী স্কুল-কোচিংয়ে যাচ্ছে তারা স্বাভাবিকভাবে যাবে।

ভিকারুন্নেসা স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেশাগত অবহেলা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যক্তির দায় কখনো প্রতিষ্ঠান নেয় না। প্রতিষ্ঠানে আরও অনেকে চাকরি করেন। তারা নিশ্চিই এমন আচরণ করছেন না। একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের যে আচরণ করা দরকার, তারা সেটাই করছেন। বিক্ষিপ্তভাবে একজন শিক্ষক যদি এ ধরনের কাজ করেন, সে দায়ভার তো অন্য শিক্ষক নেবে না।

একই প্রতিষ্ঠানে এমন অভিযোগে তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। সেই তদন্তে তাদের দায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই দায় মুক্তি পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন বলেন, এটি একটি একাডেমিক বিষয়। তদন্তের বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটি রয়েছে। তাদের দায়িত্বশীল যে জায়গাগুলো আছে, সেগুলো তারা দেখবেন। তবে ফৌজদারি বিষয়গুলো পুলিশের অংশ। এই বিষয়গুলো পুলিশ দেখছে। কর্মকর্তারা নারী ও শিশুদের প্রতি অত্যন্ত সহমর্মিতা ও ভালোবাস দেখায়। ফলে এটা দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত করা হবে।