সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে আইনের খসড়াটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়

cabinet_79864_0দৈনিকবার্তা-ঢাকা,১৮আগষ্ট : মন্ত্রিসভায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে৷এতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে আবার ফিরে আসছে৷সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন)আইন,২০১৪ এর খসড়ায় ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়৷

আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আলোকে এই সংশোধনী আনা হয়েছে৷১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ছিল৷

নতুন এই সংশোধনীতে বলা হয়৷এই আইন সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪ নামে অভিহিত হবে৷ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নরূপ ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত হবে, যথা: বিচারকদের পদের মেয়াদ৷-(১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী- সাপেক্ষে কোনো বিচারক ৬৭ (সাতষট্টি) বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন৷ প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামথ্যের্র কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না৷ এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামথর্্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷ কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন৷

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই তৃতীয়াংশ সাংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে৷পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের নিয়মটি বাদ পড়ছে৷

আইন মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন,আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনেই এ সংক্রান্ত বিলটি পাস হবে৷কোন পদ্ধতিতে একজন বিচারককে অপসারণ করা যাবে তার বিশদ ব্যাখ্যাসহ একটি আইন করা হবে বিল পাসের তিন মাসের মধ্যে৷তবে সরকারের এই উদ্যোগের সমালোচনা করে বিএনপি বলেছে, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হচ্ছে৷

১৯৭২ সালের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করেন৷

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়৷ সংশোধন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করা হয়৷ এটি করা হয়েছিল জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে, ১৯৭৮ সালে৷১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারকদের পদের মেয়াদ শীর্ষক ৯৬ অনুচ্ছেদে ২ দফায় বলা হয়- প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামথ্যের্র কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না৷

৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা ছিল, এই অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামথর্্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে৷আর ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফায় বলা হয়, কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন৷

সচিব বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের এই বিধান দিয়ে বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপিত করা হবে৷ আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এ প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসে৷ এতে বলা হয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের যে বিধান বর্তমান সংবিধানে রয়েছে তা ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি৷

একজন অভিযুক্ত বিচারক ও কাউন্সিলের সদস্য একই প্রতিষ্ঠানে অনেকদিন কাজ করার কারণে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে৷ তাছাড়া সংসদে রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ও স্পিকারকে অপসারণ করার বিধান রয়েছে; ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণেরও বিধান রয়েছে৷ মোশাররাফ হোসাইন বলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার বিষয়টি আইন মন্ত্রণায়রে প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে৷পাশাপাশি আইন কমিশনও বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত বাহাত্তরের মূল বিধানটি পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছে৷

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের এ বিধানটি আর থাকবে না, যদি বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়৷সচিব জানান, মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় খসড়াটি এখন বিল আকারে সংসদে তোলা হবে৷ সংসদের অনুমোদনের পর আরেকটি আইন করা হবে, তাতে বিচারকদের অসামথর্্য, অসদাচরণ ও অভিযোগ সম্পর্কে কীভাবে তদন্ত হবে, সংসদ কীভাবে প্রস্তাব নেবে এবং রাষ্ট্রপতি কোন প্রক্রিয়ায় তা অনুমোদন করবেন- এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা থাকবে৷এটি আলাদা কোনো বিষয় নয়, এ আইনেই তা বলা হয়েছে এবং তা আলোচনা করা হয়েছে৷

অনুমোদন দেয়ার আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অন্যান্য দেশের নজির নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মোশাররাফ হোসাইন বলেন,প্রতিবেশী দেশ ভারতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনুমোদন দিলে রাষ্ট্রপতি অপসারণের আদেশ দিতে পারেন৷যুক্তরাজ্যের নিয়ম হলো, পার্লামেন্টের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাব পাস হতে হবে, তারপর রানি তাতে অনুমোদন দেবেন৷অভিশংসনের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে দেয়া আছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও৷ প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতি পেলে বিচারকদের অপসারণ করা যায়৷

এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা,জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে একই বিধান রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান৷উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের গত সরকারের মেয়াদে৷

২০১২ সালে তত্‍কালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাই কোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়৷

সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন৷এদিকে, চিংড়িখাতের উন্নয়নে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা, ২০১৪’র অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা৷

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান৷চিংড়ি বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি করে তিন হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা আয় হয়েছে৷ চিংড়িখাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেড় কোটি মানুষ জড়িত জানিয়ে সচিব বলেন, এদের মধ্যে অনেক নারীও রয়েছেন৷

১৯৯৮ সালের জাতীয় মত্‍স্য নীতির মধ্যে চিংড়ির বিষয়টি থাকলেও, চিংড়ির গুরুত্ব অনুধাবন করে এর জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করেছে মত্‍স্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়,বলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব৷পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য, জনগণের পুষ্টিমান উন্নয়ন, বাজারজাতকরণ, রপ্তানি বাজারের সমপ্রসারণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে৷আর চিংড়ির মান উন্নয়ন, উত্‍পাদন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, ভূমি অঞ্চলীকরণ এ নীতিমালার উদ্দেশ্য৷মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নীতিমালার ফলে চিংড়িখাতের উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করবে বেসরকারি খাত৷ আর সরকার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে৷