বুদ্ধিজীবীদের মর্যাদা ও দেশপ্রেমবোধ

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর: রোববার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস৷ ১৯৭১ সালের এ দিনে দখলদার পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সনত্মান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে৷বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন পাকিসত্মানী বর্বর বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে৷

বিনয় এবং শ্রদ্ধায় আজ জাতি সেসব বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করবে৷ একই সাথে এবারও জাতির প্রত্যাশা, জাতির শ্রেষ্ট সনত্মানদের যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের রায কার্যকর করে, দেশকে কলংক মুক্ত করা হবে৷শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পসত্মবক অর্পণ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন৷ দিনব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা, মৌন মিছিল ইত্যাদি৷ এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্নার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে৷দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ , প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন৷

বাণীতে খালেদা জিয়া বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শাহাদত্‍ বরণকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই৷ তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি৷ ১৪ ডিসেম্বর একটি বেদনাময় দিন৷ বাংলাদেশকে মেধা মননে পঙ্গু করার হীন উদ্দেশ্যে চুড়ান্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে এ দিনে হানাদার বাহিনীর দোসররা দেশের প্রথিতযশা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিত্‍সক বিজ্ঞানীসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করোছিলো৷ তারা মনে করেছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করলেই এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে এবং উন্নয়ন অগ্রগতি রুদ্ধ করে দেয়া যাবে৷ কিন্তু তাদের সে লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে৷

তিনি বলেন, অমর বুদ্ধিজীবীগণ দেশের বরেণ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান যাঁরা একটি সমৃদ্ধ এবং মাথা উঁচু করা জাতি দেখতে চেয়েছিলেন৷ তাঁরা ন্যায় বিচারভিত্তিক শোষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা করেছিলেন৷ দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা আন্তর্জাতিক অপশক্তি তাদের সে প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি৷ স্বাধীনতার পর থেকেই অগণতান্ত্রিক শক্তি তাদের মুখোশ খুলে ফেলে দেশের মানুষের সার্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো একের পর এক অমানবিক কায়দায় দমন করে, আর এই কারণেই সীমাহীন রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্ব দিনে দিনে দূর্বল করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে৷ বিভেদ অনৈক্য এবং সংকীর্ণতার দ্বারা জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে৷ সুতরাং আমাদের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ এবং দেশকে একটি সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে হবে৷ এ ক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবীগণ আমাদের প্রেরণার উত্‍স হিসেবে কাজ কারে যাবেন বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া৷

এদিকে,শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাণীতে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আমি বিজয়ের চুড়ান্তক্ষণে শাহাদাত্‍বরণকারী বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই৷ তাঁদের রুহের মাগফিরাত কমনা করি৷

১৪ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে এক শোকাবহ দিন৷ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে হানাদার বাহিনীর দোসররা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বেছে বেছে হত্যা করেছিলো৷ পৈশাচিক সে হত্যাকান্ড জাতির জীবনে সৃষ্টি করেছিলো এক গভীর ক্ষত৷শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, যার আদর্শ হবে গণতন্ত্র৷ তাঁদের স্বপ্ন পূরণে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে৷ আজকের এ দিনে আমি সকলের প্রতি সে আহবান জানান ফখরুল৷

জাতি এ বছর এমন একটি প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে যখন একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সংশিস্নষ্টদের বিচার কাজ এগিয়ে চলছে৷ এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্বে ফাঁিসর রায় ঘোষিত হয়েছে৷ মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দন্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোলস্নার ফাঁিসর দন্ড কার্যকর হয়েছে৷ জামায়াতের অপর নেতা মো: কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় আপিল বিভাগে বহাল রয়েছে৷ চূড়ানত্ম রায় হয়েছে আরো কয়েকজনের ৷

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিসত্মানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিত্‍সক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়৷পরে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তারের ব্রাশফায়ার করে,বেয়নটে দিয়ে খুঁচিয়ে,অনকেকে লাইন ধরিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত৷

মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আল-বদর বাহিনী আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল-বদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে৷

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন-অধ্যাপক মুনির চৌধুরী,ডা.আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরম্নজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সনত্মোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোসত্মফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে৷

একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ তাত্‍পর্য বহন করে৷৷ তারা শহীদ হন এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে৷ হানাদার পাকিসত্মানী বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে৷তারা স্পষ্ট দেখে- চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সনি্নকটে- তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে৷ তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে৷ তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত্‍কে এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল৷

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে যতই ষড়যন্ত্র হোক, তাদের বিচার এ বাংলার মাটিতে হবে৷ কোন চক্রানত্ম এই বিচার কাজকে ব্যাহত করতে পারবে না৷

তিনি বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধীদের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান৷কর্মসূচি ঃ সকালে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পসত্মবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরম্ন হবে৷

রোবাবর সকাল ৮টা ৫ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং পরে ৮টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুর শহীদ বুদ্বিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করবেন৷ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা পুস্পসত্মবক অপর্ণ করবেন৷ এর পরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বসত্মরের মানুষ স্মৃতিসৌধে পুষ্পাঘর্্য অর্পণের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সনত্মান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন৷ সকাল ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা রায়ের বাজার বধ্যভুমি স্মৃতিসৌধেও পুস্পসত্মবক অর্পন করবেন৷

দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিসত্মারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ প্রতিবারের মত এবারও দেশবাসীর সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্য সহকারে এই শোকাবহ দিনটিকে স্মরণ ও পালন করবে৷এ উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ৷

সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পাঘর্্য নিবেদন এবং ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঘর্্য নিবেদন৷ এছাড়াও সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধাঘর্্য অর্পণ, বিকেল ৩টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে(খামার বাড়ী, ফার্মগেট) আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে৷ এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷

এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিএনপি,জাতীয় পার্টি, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু একাডেমী, উদীচী, ন্যাপ ভাসানী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷