a1a853b2ba96c9040908b805611219f4-12

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০২ মার্চ: লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সেই শাফিউর রহমান ফারাবীকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে, যিনি এর আগে ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ফেইসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট রকমারি ডটকম থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরাতেও হুমকি দিয়েছিলেন। সোমবার দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ ব্রিফিং করে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় শফিউর রহমান ফারাবীকে র‌্যাবের সদর দপ্তরে হাজির করা হয়।সংবাদ ্িব্রফিংয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন,সোমবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবায়ী এলাকা থেকে ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে।অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফারাবী সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, কোনো অপরাধীই প্রথমে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে না। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে; তবে কৌশলগত কারণেই এখনই সব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না বলে জানান এই র‌্যাব কর্মকর্তা।সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন। তবে তিনি পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পারেননি। প্রথমে তিনি বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করতেন, পরে নিজের নামে ফারাবী ব্লগ চালু করেন।

র‌্যাবের ভাষ্য, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবী দাবি করেছেন, ব্লগে লেখালেখির সূত্রে অভিজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। একপর্যায়ে লেখালেখি নিয়ে অভিজিতের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। গত দুই বছর ধরে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই।র‌্যাব জানায়, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফারাবীর সম্পৃক্ততার নানা তথ্য প্রমাণ তারা পেয়েছে। যেমন, অভিজিৎ রায় ও তাঁর পরিবারের বিভিন্ন তথ্য ফারাবী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের মাঝে প্রচার করতেন। তাঁকে হত্যার জন্য উসকানি দিতেন। ফারাবী তাঁর ফেসবুকে জানিয়েছেন, অভিজিৎ রায় তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকেন। তাঁর ব্যাপারে আমেরিকায় বসবাসরত তাঁর অনুসারীরা খোঁজ খবর রাখছে। আরেকবার ফারাবী অভিজিতের পরিবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে বলেছেন, অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।গত ২৬ ফেব্র“য়ারি রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হামলার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ গুরুতর জখম হন। তিনি এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।অভিজিতের ঘনিষ্ঠজনদের অভিযোগ, লেখালেখি করার কারণে তাঁকে বিভিন্ন সময় ব্লগ ও ফেসবুকে হুমকি দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে শফিউর রহমান ফারাবীও রয়েছেন।

পুলিশ জানায়, ব্লগারদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার জন্য ফারাবীকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে যান। র‌্যাবের ব্রিফিংয়েও আজ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।অভিজিৎ খুনের ঘটনায় তাঁর বাবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে গত ২৭ ফেব্র“য়ারি শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় তিনি কোনো আসামির নাম বা কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ব্লগে লেখালেখির কারণে উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত-শিবির।অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একাধিক সূত্র জানায়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে তাঁরা মনে করছেন, এ ঘটনায় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে সন্দেহের শীর্ষে রাখা হয়েছে। ডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ছাড়াও আরও কয়েকটি সন্দেহকে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত চলছে। টুইটারে ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করার মাধ্যমে কেউ প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ফেসবুকে অভিজিৎকে হুমকিদাতা শফিউর রহমান ফারাবীকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে ডিবি।

অভিজিৎ রায় ও রাফিদা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। অভিজিৎ মুক্তমনা ব্লগের সম্পাদক ও লেখক। কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম পদক পায় মুক্তমনা। রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে। অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, অবিশ্বাসের ভাইরাস।অভিজিৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। আট বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী তিনি। এ বছরের ১৬ ফেব্র“য়ারি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। চলতি মাসে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান জানান, উগ্রপন্থি ব্লগার ফারাবীই লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন। সোমবার সকালে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করলে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ২৬ফেব্র“য়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। হামলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বন্যার একটি আঙুল।যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা।তার খুনের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও প্রধান শিরোনাম হয়।জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানায়।যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তার আগ্রহ দেখালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতি দেওয়া হয়েছে বলে রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের জানান।হত্যাকাণ্ডের পর ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ফারাবীর নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। তিনি অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন অভিযোগ করে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আসা একটি কমেন্ট শেয়ার করা হয়।একজনকে উদ্দেশ করে ওই কমেন্টে বলা হয়, অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।

দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে বাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ৪-৫ বছর আগে ফারাবীর সঙ্গে অভিজিতের ফেইসবুকে যোগাযোগ হয়। কিন্তু বিপরীতমুখী আদর্শের কারণে অভিজিৎ দুই বছর আগে ফারাবীকে ব্লক করে দেন।বিভিন্ন সময়ে ফারাবী ফেইসবুকে অভিজিতের পরিবারের সদস্যদের ছবি ও স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যাতে দেশে এলে অভিজৎকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।তাছাড়া ফেইসবুকে ফারাবী ব্লগ নামের একটি পৃষ্ঠায় তিনি ধর্মীয় উসকানিমূলক স্ট্যাটাসও দিতেন বলে মুফতি মাহমুদ জানান।২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ফারাবী।ওইবছর ২৪ ফেব্র“য়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকা থেকে পুলিশ ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে। ফেইসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে জুন মাসে ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করে।কিন্তু হাই কোর্টের জামিনে ২০১৩ সালের ২১ অগাস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান ফারাবী। আর মুক্তি পেয়েই নাস্তিকদের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে তিনি ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, যাতে বলা হয় আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।

এদিকে অভিজিৎকে হত্যার পর আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একাধিক টুইট করে এ হত্যাকাণ্ডকে বিজয় হিসেবে দাবি করা হয়।এর একটিতে বলা হয়, আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন..। আর অন্যটিতে অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়, ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইসলামবিরোধী ব্লগার আমেরিকান বাঙালি অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে।আনসার বাংলা সেভেন নামে কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বা অভিজিত হত্যায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে তাদের সন্দেহের তালিকায় যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনও রয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায় তা স্পষ্ট।হত্যাকাণ্ডের পরদিন শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ও জঙ্গিদের সন্দেহের কথা বলেন।থানায় উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরাই দায়ী। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত।

অজয় রায়ের করা ওই মামলাতেই ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান।তিনি বলেন, ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হলেও ২০১০ সালে হিজবুত তাহরীরে সক্রিয় হয়ে লেখাপড়া শেষ করেনি। নাশকতার অভিযোগে সে একমাস জেলও খেটেছিল।বিজ্ঞানমনস্ক অভিজিৎ লিখতেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে অবিশ্বাসের দর্শন, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, ভালবাসা কারে কয়,স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা : বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান।