DoinikB rta_দৈনিকবার্তা884_1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ এপ্রিল: ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট বর্জনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিন সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই মেয়র নির্বাচিত হয়েছে।চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন, ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক এবং দক্ষিণে সাঈদ খোকনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। তিন সিটিতে ভোটের মধ্য দিয়ে দেশের সব সিটি করপোরেশনে বর্তমানে নির্বাচিত মেয়র পাওয়া গেলো।তবে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগ এনে তিন সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। একই অভিযোগ তোলেন বাম দলগুলোর প্রার্থীরাও।তবে এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তিনটি কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় ভোট বাতিল হয়েছে।ফলাফল মেনে নিয়ে প্রার্থী ও সমর্থকদের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।মঙ্গলবার ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের পর রাতভর ভোট গণনা শেষে তিন মেয়রের নাম ঘোষণা করেন কর্মকর্তারা।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক।১০৯৩ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে আনিসুল পেয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল বাস প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন।৮৮৯টির মধ্যে ৮৮৬ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে ইলিশ প্রতীকের সাঈদ খোকন পেয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। গোলযোগের কারণে তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত হলেও, ওই সব কেন্দ্রের ভোটের যোগফল দুই প্রার্থীর ব্যবধানের চেয়ে কম হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন। মোট ৭১৯টি কেন্দ্রের সবগুলোর ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে হাতি প্রতীক নিয়ে নাছির পেয়েছেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট।তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম কমলা লেবু প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের ঘটনায় নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষ আস্থা হারাবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, এই নির্বাচন দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। যে নির্বাচন হয়েছে তা কারও প্রত্যাশিত ছিল না বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই নির্বাচনে তিনটা জিনিসের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থার ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচনের এমন পরিবেশকে অকল্পনীয় আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এখন তো খণ্ড খণ্ড চিত্র পাচ্ছি। যা দেখলাম বিভিন্ন সংস্থা থেকে খবর আসছে। এতটাই অকল্পনীয় যে, এমনটি কেউ আশা করে না।

সিটি নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনা রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, দোষগুণ বিশ্লেষণ না করেও এটা স্পষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এই নির্বাচনে সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সঙ্কট তিরোহিত না হলে অচিরেই আমরা অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হবো। তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচন জাতির জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী বড় ক্ষতির কারণে পরিণত হবে।জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগ প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ৩ সিটি নির্বাচনে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। ১৩ বছর নাগরিক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগপেয়েও করতে পারেনি। তারা নির্বাচনে যা প্রত্যক্ষ করেছে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। দুটি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ফলে যেমন উৎসাহ- উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ফলে সেটি শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়লে যা হয় তাই হয়েছে এই সিটি নির্বাচনে। ইলেকশন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসি তো রেফারির দায়িত্বে ছিল। মাঠে যদি খেলোয়াড়ই না থাকে তাহলে রেফারি কী করবে বা তার কী বা করার আছে।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইখতেখারুজ্জামান বলেন, এই নির্বাচনকে নিয়ে আমরা খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু যা হয়েছে তাতে খুব হতাশ হয়েছি কিন্তু অবাক হয়নি। নির্বাচনে এক ধরনের ঝুঁকি ছিল এটা মাথায় নিয়ে কাজ করেনি ইসি ও প্রশাসন। দুটি দলের প্রার্থীরা যে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ইলেকশন কমিশন ও প্রশাসন সেটি ধরে রাখতে পারেনি। আমি মনে করি এই নির্বাচনের পর এই সংকট আরও ঘণীভূত হবে। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের জেতাতে হবে যে কোন উপায়ে প্রশাসনের এমন মনোভাব থেকেই হয়তো ভোটে এ ধরনের কারচুপি হয়েছে। বিএনপি যে ইস্যুতে নির্বাচন বয়কট করেছে সেটির একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।

আমাদের নৈতিক জায়গার ওেয পতন হয়েছে সেটি আজকে ঘটনার মূল কারণ। এই নির্বাচনে কেন্দ্রীয় জাতীয় সংকট তৈরি হয়েছে তা কিছুটা দূর করা সম্ভব হতো।এ এক নয়া মডেলের নির্বাচন। উৎসব তো বটেই। দখলের উৎসব। একেবারেই খোলামেলা। কোন রাখডাক নেই। সকাল সকাল প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই হাওয়া বিএনপি সমর্থক এজেন্টরা। কেউ ঢুকতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। তবে থাকতে পারেননি কেউই। হুমকি, মারধর, হামলা আর গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন তারা। কাউকে কাউকে আটকে রাখা হয় আগেই। রক্তাক্ত এজেন্ট যেন একটি নির্বাচনেরই প্রতিচ্ছবি। আভাস পাওয়া গিয়েছিল আগের রাতেই। খবর আসছিলো, ব্যালট পেপারে সিল মারার। যদিও তার সংখ্যা ছিল কম। তবে দিনের শুরুতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম বাধার শিকার গণমাধ্যম। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ক্যামেরা নিতে মানা। দিনভর টার্গেট সাংবাদিকরা। কেন্দ্র বিরোধী এজেন্টমুক্ত করার পর বিরোধী ভোটারমুক্তও করা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তাদের শতভাগ সহযোগী। কোথাও কোথাও অগ্রণী ভূমিকায়। কেন্দ্রের সামনে বিরোধীরা যেন আসতে না পারেন তা নিশ্চিত করা হয় শতভাগ। এরইমধ্যে চলে গায়েবি ভোট। প্রকাশ্যে ব্যালটে সিলমারা। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাই শুধু নয় এমনকি কোথাও কোথাও নির্বাচনী কর্মকর্তাদেরও দেখা গেছে ব্যালটে সিল মারতে। কোথাও কোথাও ভোটাররা ভোট দিতে গেলে বলা হয়, দেরি করে ফেলেছেন। অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে কয়েকটি কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বলাবাহুল্য, এ সংঘর্ষ হয়েছে সরকারি দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যেই। সার্বিক পরিস্থিতিতে দুপুরেই নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, একশ ভাগ ভোট পড়লেও অবাক হবো না। তবে এতো কিছুর পরও সেনা সদস্যরা অবশ্য মোতায়েন ছিলেন সেনানিবাসেই। কোথাও তাদের ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ যেন জোর যার, ভোট তার। কেউ কেউ বলছেন, ডিজিটাল জমানায় এনালগ কারচুপি। ভোটের শুরুতেই নানা কেন্দ্র থেকে খবর আসতে থাকে বিএনপির নেতৃত্বের কাছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরে হতাশাজনক চিত্র দেখেন প্রার্থীরা। দ্রুতই এগুতে থাকেন নির্বাচন বর্জনের দিকে। প্রথম ঘোষণা আসে অবশ্য চট্টগ্রাম থেকে। বেলা ১২টার আগেই কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে যান মনজুর আলম। একইসঙ্গে রাজনীতি থেকেও অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন- উত্তরের মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। মওদুদ আহমদ বলেন, র‌্যাব-পুলিশ এবং সরকারি দলের লোকজন আমাদের সব এজেন্টকে বের করে দিয়েছে। এটা কোন নির্বাচন হয়নি। এটা একটি ভোটবিহীন প্রহসনের নির্বাচন। এ নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। তবে শুধু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীই নয়, আলোচিত বেশির ভাগ মেয়রপ্রার্থীই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টি, সিপিবি সমর্থিত প্রার্থীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন জোনায়েদ সাকী, গোলাম মাওলা রনির মতো প্রার্থীরা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ। যদিও দিনভর জালভোটের উৎসব আর বিএনপির বর্জনের পর এ নির্বাচনে কারা জয়ী হচ্ছেন তা নিয়ে অবশ্য কারো কোন আগ্রহ ছিল না। তিন ক্ষমতাসীন সমর্থিত প্রার্থীর নাম- ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন, চট্টগ্রামে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন।

কলঙ্কজনক ভোট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে সবকিছু এত খোলামেলা হওয়ার ঘটনা সম্ভবত এবারই প্রথম। একদিনের বাদশারা তাদের রায় দিতে পারবেন কি-না তা নিয়ে আগেই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল,নজিরবিহীন ভোটের। ভোট নজিরবিহীনই হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মঙ্গলবার কোন মঙ্গল বয়ে আনেনি। গায়েবি ভোটের উৎসবে ম্লান হয়েছে গণতন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এ নিয়ে বেশি বলাও অবশ্য মুশকিল। কিছু কিছু পত্রিকা বলেছিল, এ নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বলা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আরও একবার পরাজিত হয়েছে।

নির্বাচন বর্জন করলেন যারা: ২০দলীয় জোট ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন, স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মাওলা রনি, জোনায়েদ সাকীও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়া, জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাপক কারচুপি ও সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র দখলের প্রতিবাদে এই ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই বর্জনের ঘোষণা দেন মেয়রপ্রার্থীরা। প্রাার্থীরা বলেন, ভোটগ্রহণ শুরুর পর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়া, জালভোট প্রদান ও ভোটকেন্দ্র দখল করে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভোট প্রদানসহ নানা অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করছি। এ প্রহসনের নির্বাচনকে আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আমরা এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছি। চট্টগ্রাম থেকেও আমাদের মেয়র প্রার্থী ওয়ায়েজ হোসেন ভূঁইয়া নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী না নামিয়ে সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের ভোট ডাকাতির সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা এ নির্বাচন বর্জন করছি এবং এ নির্বাচন বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে বিরোধী জোটের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসার পর ঢাকা উত্তরের মেয়রপ্রার্থী জোনায়েদ সাকীও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল দুপুরে নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।মঙ্গলবার দিনভর ভোটগগ্রহণের পর ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এই তিনজনই প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেন।মঙ্গলবার ভোটের মাঝখানে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রায় সব কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগ এনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। একই অভিযোগ তোলে বাম দলগুলোও।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, এটা কোনো নির্বাচন হয় নাই। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। ভোটবিহীন এই নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। … এই নির্বাচন আমরা বর্জন করি। এতে গণতন্ত্রের প্রহসন করা হয়েছে।এসময় ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস এবং উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল পাশে ছিলেন মওদুদের। চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম এর ঘণ্টাখানেক আগেই ভোট বর্জনের কথা জানান।তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, জনমত বিপক্ষে জেনে নির্বাচনকে টওশ্নবিদ্ধ করতেই বিএনপি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোট বর্জন করেছে।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেখাতে পারেনি। কোনো একটি অনিয়মের তথ্য দিতে পারেনি বিএনপি।প্রধান দুই দলের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তিনটি কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় ভোট বাতিল হয়েছে।ফলাফল মেনে নিয়ে প্রার্থী ও সমর্থকদের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান সিইসি।মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলে তিন সিটি করপোরেশনে।অন্তত ২০টি কেন্দ্রে গোলযোগের খবর পাওয়া গেলেও ঢাকা দক্ষিণের তিনটি কেন্দ্রেই কেবল ভোট স্থগিত হয়েছে।এ তিন সিটিতে ভোটের মধ্য দিয়ে দেশের সব সিটি করপোরেশনে বর্তমানে নির্বাচিত মেয়র হল।চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন।মোট ৭১৯টি কেন্দ্রের সবগুলোর ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে হাতি প্রতীক নিয়ে নাছির পেয়েছেন ৪,৭৫,৩৬১ ভোট।তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম কমলা লেবু প্রতীকে পেয়েছেন ৩,০৪,৮৩৭ ভোট।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক।

১০৯৩ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে আনিসুল পেয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল বাস প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৯৩টি। অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়নি।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন।৮৮৯টির মধ্যে ৮৮৬ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে ইলিশ প্রতীকের সাঈদ খোকন পেয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট।গোলযোগের কারণে তিনটিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত হলেও ওই সব কেন্দ্রের ভোটের যোগফল দুই প্রার্থীর ব্যবধানের চেয়ে কম হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে মাহী বি চৌধুরী (ঈগল) ১৩৪০৭, জোনায়েদ সাকি ( টেলিস্কোপ) ৭৩৭০, কাফি রতন (হাতি ) ২৪৭৫, বাহাউদ্দিন আহমেদ বাবুল (চরকা) ২৯৫০, নাদের চৌধুরী (ময়ূর) ১৪১২, এ ওয়াই এম কামরুল ইসলাম (ক্রিকেট ব্যাট) ১২১৬, কাজী মো. শহীদুল্লাহ (ইলিশ) ২৯৬৮, শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ (কমলা লেবু) ১৮০৫০, শামছুল আলম চৌধুরী (চিতাবাঘ) ৯৮২, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ (ফ্লাক্স) ১০৯৫, চৌধুরী ইরাদ আহম্মদ সিদ্দিকী (লাউ) ৯১৫, মো. আনিসুজ্জামান খোকন (ডিশ এন্টেনা) ৯০০, মো. জামান ভূঞা (টেবিল) ১১৪০ ও শেখ শহিদুজ্জামান (দিয়াশলাই) ৯২৩ ভোট পেয়েছেন।ঢাকা দক্ষিণের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে আব্দুর রহমান ফ্লাস্ক প্রতীকে ১৪,৭৮৪ ভোট, সোফা প্রতীকে জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন মিলন ৪৫১৯ ভোট, চরকা প্রতীকে আবু নাছের মোহাম্মদ মাসুদ হোসাইন ২,১৯৭ ভোট, টেবিল ঘড়ি প্রতীকে রেজাউল করিম চৌধুরী ২,১৭৩ ভোট, জাহাজ প্রতীকে শাহীন খান ২,০৭৪ ভোট, আংটি প্রতীকে গোলাম মওলা রনি ১,৮৮৭ ভোট, বাস প্রতীকে শহীদুল ইসলাম ১,২৩৯ ভোট ও টেবিল প্রতীকে সিপিবি-বাসদের বজলুর রশীদ ফিরোজ ১,০২৯ ভোট পেয়েছেন।ল্যাপটপ প্রতীকে জাহিদুর রহমান ৯৮৮ ভোট, কমলা লেবু প্রতীকে বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান রিপন ৯২৮ ভোট, ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে এ এস এম আকরাম ৬৮২ ভোট, হাতি প্রতীকে দিলীপ ভদ্র ৬৬৯ ভোট, কেক প্রতীকে আব্দুল খালেক ৫৫০ ভোট, ময়ূর প্রতীকে শফিউল্লাহ চৌধুরী ৫১২ ভোট, চিতা বাঘ প্রতীকে মশিউর রহমান ৫০৮, লাউ প্রতীকে মো. আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ ৩৬২ ভোট, ঈগল প্রতীকে আয়ুব হোসেন ৩৫৪ ভোট এবং শার্ট প্রতীকে বাহরানে সুলতান বাহার ৩১৩ ভোট পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন চরকা প্রতীকে ১১,৬৫৫ ভোট, ওয়ায়েজ হোসেন ভুঁইয়া টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ৯,৬৬৮ ভোট, জাতীয় পার্টি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ ডিশ অ্যান্টেনা প্রতীকে ৬,১৩১ ভোট, ইসলামিক ফ্রন্টের হোসাইন মোহাম্মদ মুজিবুল হক শুক্কুর ময়ূর প্রতীকে ৪,২১৫ ভোট, সাইফুদ্দিন আহমেদ রবি ফ্লাক্স প্রতীকে ২,৬৬১ ভোট, গাজী মো. আলাউদ্দিন টেলিস্কোপ প্রতীকে ২,১৪৯ ভোট, বিএনএফের আরিফ মঈনুদ্দিন বাস প্রতীকে ১,৭৭৪ ভোট, আবুল কালাম আজাদ দিয়াশলাই প্রতীকে ১,৩৮৫ ভোট, সৈয়দ সাজ্জাদ জোহা ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে ৮৪৫ ভোট এবং শফিউল আলম ইলিশ মাছ প্রতীকে ৬৮০ ভোট পেয়েছেন।সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ৪৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ঢাকা উত্তরে এবং বেশি ভোট পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে।নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।ভোটের ফলাফল অনুযায়ী, তিন সিটির মোট ভোটার হচ্ছে ৬০ লাখ ২৯ হাজার ২৭৮ জন। এদের মধ্যে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ২৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭২৮টি। যা মোট ভোটারের ৪৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এছাড়া তিন সিটি নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ২৫ লাখ ২৭ হাজার ৭২৫টি। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩টি ভোট বাতিল হয়েছে। যা প্রদত্ত ভোটের ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ডিএনসিসি: সিটি ভিত্তিক ভোটের ফলাফল থেকে দেখা গেছে-ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে মোট ভোটার হচ্ছে ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯শ জন। এর মধ্যে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৮টি। যা মোট ভোটের ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৪১ হাজার। এছাড়া বাতিল হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৮১টি ভোট।

ডিএসসিসি: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৮ জন। এদের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪ জন। যা মোট ভোটের ৪৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৩৫৪টি। এছাড়া বাতিল হয়েছে ৪০ হাজার ১৩০টি ভোট। এ নির্বাচনে ৩টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিলো। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ৩ কেন্দ্রের ভোটের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় এ নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হবে না।

চসিক: এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৬০০জন। এদের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৩জন। যা মোট ভোটের ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ২১ হাজার ৩৭১টি। এছাড়া বাতিল হয়েছে ৪৭ হাজার ২৯২টি ভোট।