Ctg+Navy_Recover_Malaysiya_Root+(2)

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২১ মে: গত ০৪ মে মালয়েশিয়ার সীমান্তে লাংকাওয়ি দ্বীপে একহাজার ১৮ জন অভিবাসী পৌছেছে তার মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশি বাংলাদেশী। এভাবে প্রায়শই বাংলাদেশিরা পাচারের শিকার হচ্ছেন। পাচারের সাথে চার দেশের সিন্ডিকেট জড়িত বলে বিবিসি সূত্রে দৈনিক নয়া দিগন্ত এ তথ্য প্রদান করেছে। মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা কারাম জানিয়েছেন, সীমান্তে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সমর্থন ছাড়া এমন পাচার সম্ভব নয়। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এ চার দেশের মানব পাচারকারী জড়িত। এই পাচারকারি চক্রকে চিহ্নিত ও শাস্তি দেয়া প্রথমত রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে বারবার নিষেধ করছে।

কিন্তু তাদের এ নির্দেশ উপেক্ষা করা হচ্ছে। তার কারণ যে সব পাচারকারি সদস্য বিভিন্ন সময়ে আটক হয়েছেন তারা অদৃশ্য শক্তির ইশারায় জামিনে বেড়িয়ে যেতে পারছে বলেই পাচার কারীদের ঠেকানো যাচ্ছেনা। আবার বিদেশের মাটিতে কেউ যখন সমস্যায় পড়েন তখন তাকে নিরাপদে উদ্ধার করার দায়িত্বটা সরকারের উপরেই বর্তায়। অনেক ক্ষেত্রেই সেসব স্থান থেকে ব্যক্তিগত ভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ইন্দোনেশিয়ার নৌ বাহিনীর সদস্যরা সাগরে ভাসমান অবৈধ অভিবাসিদেরকে তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি। এটি অমানববিক কাজের সুস্পষ্ট উদাহরণ। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে প্রথমত তাদেরকে উদ্ধার করা প্রয়োজন ছিল। কেউ অপরাধ করলে সে জন্য তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু তাদেরকে সাগর থেকে উদ্ধার না করে খাদ্য ও পানি দিয়ে সাহায্য করা মূলত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। এ ব্যাপারে সরকারের অগ্রণি ভূমিকা পালন করা উচিত।

কেননা দেশে চাহিদানুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই বলেই অনুপায় হয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হন। নাগরিকদের সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারকেই কাজ করা উচিত। সাধারণ মানুষের একটি বৃহৎ অংশ বেকার। তারা হতাশায় ভুগছেন। তাই তারা আয় রোজগারের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ গুম, খুন, মাদক ব্যবসা ও নানা ধরণের অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বিরোধীদলের নেতা কর্মীদের দমনের বেলায় রাজনীতির মাঠে আইনশৃঙ্খলাবাহিনকে যতবেশি সোচ্চার হতে দেখা যায় অন্য কোন বেলায় সে রকম তৎপর হতে দেখা যায় না।

বিরোধী দলের যে কাউকে দমন পীড়নে অতিরিক্ত আইনের প্রয়োগ করতে পারলেও মানব পাচার রোধে, স্বর্ণের চোরা চালান ঠেকাতে, ব্যাংক ডাকাতি কমাতে সরকারের সফলতা নেই বললেই চলে। এসব দেখে মনে হচ্ছে বিরোধী মতালম্বীদের পেছনে পেছনে লেগে থাকাই যেন সরকারের সাংবিধানিক কাজ। দেশের উন্নয়ন কীভাবে করা যাবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বেকার সমস্যার দূরীকরণ, মানব পাচার কী উপায়ে বন্ধ, রেমিটেন্স বাড়ানোর উদ্যোগ, শ্রমিকদেরকে দক্ষ করে তোলার মতো নানা পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরণের কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করছিনা।

থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অসংখ্য গণকবরের দেখা মিলছে। নৌ পথে বিদেশ পাড়িদেয়ার সময় মাঝ পথে জ্বালানি শেষ যাওয়ায় পাচারকারি সদস্যরা তাদেরকে সেখানেই ফেলে রেখে যাচ্ছে। অজানা এক স্থানে দিনের পর দিন মাসের পর মাস সেখানেই অবস্থান করতে হচ্ছে। মুক্তিপণের টাকা না দিতে পারলে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। গাছে ঝুলিয়ে পেটানো, খাবারে কষ্ট দেয়া হয়। পানির বদলে প্রসাব খেকে দেয়া হয়। এছাড়া গত তিন বছরে সাগরে ট্রলারডুবিতে পাঁচ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী মারা যায়। নিখোঁজ প্রায় দুই হাজারেরও বেশি। দৈনিক ইত্তেফাকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সিরাজগঞ্জের দুই শতাধিক লোকের সন্ধান মিলছেনা। অনেকেই ধারণা করছেন তারাও অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিয়ে থাকতে পারেন। আবার পাচারকারীদের একটি দল বিপদগ্রস্থ ব্যক্তিদের উদ্ধারকারি হিসেবে সহায়তার নামে পরিবারের নিকট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। যার ফলে কেউ কেউ দেশের মাটিতে আসতে পারছেন। আর যারা পাচারকারীদের চাহিদানুযায়ি টাকা দিতে পারছেনা তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, অভূক্ত রেখে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। কাউকে জোড় করে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রুজি-রোজগারের প্রেষণা থেকেই তারা এই ধরণের ঝুকিপূর্ণ পথ নিয়েছেন। যা তাদের জন্য মোটেই সঠিক ছিলনা। অর্থাপার্জন করতে হবে তাই বলে রাষ্ট্রীয় সব বাধা উপেক্ষা করে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবো কি-না তা হয়তো কখনো ভাবেন নি। অবৈধ পথে পাড়ি সফল হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগন্য। অধিকাংশ লোকেরাই বিপদে পড়েছেন। সে কারণে কষ্ট করে হলেও দেশের মাটিতে কর্মসংস্থানর সর্বাত্মক প্রয়াস চালানো উচিত।

মানব পাচারের সাথে যুক্ত থাইল্যান্ডের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু হয়েছে। সেখানকার ৫১ জন সন্হেভাজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় না এনে বরং বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীরা সরকারের ছত্র-ছায়ায় থাকায় তাদেরকে সুনজরে দেখা হচ্ছে। প্রকৃত কোনঅপরাধী ধৃত হলে তাদের দেয়া তথ্যে সরকারি দলের কোন এমপি, মন্ত্রী বা কোন রাজনৈতিক দলের নেতার বেড়িয়ে আসতে পারে সে কারণে অপরাধীকে ধরামাত্র মুহূর্তেই তাকে সাজানো বন্ধুক যুদ্ধের শিকার হতে হয়। এছাড়া অনেক অপরাধি চক্র আছে যারা সব সরকারের আমলে সরকারি দলে থাকে। একটি দেশের জন্য এ ধরণের ন্যায়ভ্রষ্ট শাসন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অকল্যাণ। সরকারের উচিৎ দল-মত নির্বিশেষে প্রকৃত অপরাধীকে খুজে বের করে তাকে শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ইতোমধ্যে মানব পাচার বন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জাতিসংঘের সার্বিক সহযোগীতা চেয়েছেন। তাদের তথ্য মতে, চলতি বছরে নৌকায় করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নিহত হয়েছে প্রায় ১৮০০ অভিবাসী। এতদিন সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি উদ্ধার হলেও সম্প্রতি আকাশপথে লিবিয়ায় পাচারের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশের হাতে আটককৃত এক দালালের স্বীকারুক্তি অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৫০০ লোককে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এভাবে মানব পাচারের সংখ্যা যে হারে বেড়ে চলছে তা বন্ধ না করা না গেলে নতুন করে সমস্যা দেখা দিবে। তাই মানব পাচার রোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থ্া নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিচার প্রক্রিয়ায় বড় ধরণের আইনি দুর্বলতা রয়েছে। এ আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জবাবদিহির বাহিরে রাখা হয়েছে এবং অবৈধভাবে বিদেশ গিয়ে কোন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করলে তার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এছাড়া বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে বছরে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাঁদাই ভরসা। অবৈধ পথে অভিবাসন বন্ধে আন্তরাষ্ট্রীয় যৌথ কমিশন গঠন করা দরকার।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য সবাই চেষ্টা করে। কেউ সফলতা লাভে সক্ষম হয় আর কেউ হতে পারেনা। এক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য তাকে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যেতে হয়। সুন্দর একটি পরিকল্পনা জীবনকে সুখি ও সমৃদ্ধ করে তোলে। সে জন্য কেউ নিজ দেশে থেকেই সুখ খুজে নেয়, আবার কেউ বিদেশের পথে পাড়ি দিয়ে সুখি হতে চান। কিন্তু সুখের জন্য যে পথটি বেছে নিয়েছেন, সেটা কতটা নিরাপদ, তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন ? হয়তো গভীরভাবে ভাবেন নি। যদি সুফল-কুফল ভালভাবে জেনে নিতেন তাহলে হয়তো অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। যারা বিদেশ যাচ্ছেন তাদের কী মোটই কোন দায়িত্ব নেই ? স্বচ্ছল হওয়ার গুরুত্বটা যত বেশি তার চেয়ে কি বেঁচে থাকার গুরুত্বটা কোন অংশেই কম নয়। যেখানে সুস্থ থাকার নিরাপত্তা নেই ! সঠিকভাবে নিরাপদে গন্তব্যে পৌছবে সে নিরাপত্তা নেই ! এমনকি বেচে থাকার নিরাপত্তা নেই ! সেই অজানা পথে পাড়ি দিয়ে জীবন-মরণ ঝুকি নেয়া উচিত নয়। সব দায়িত্বই কেন সরকারের নিতে যাবেন। ব্যক্তির কী কোনই দায়িত্ব নেই ? মনে রাখা দরকার, ব্যক্তি যখন নিজে সচেতন হয় তখন সেখানে সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করে। এভাবেই একটি পরিবার, একটি সমাজ, গোটা দেশ ইতিবাচক পথে পরবর্তন হতে পারে।