12-08-15-PM-1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১২ আগস্ট ২০১৫: অন্যের অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে সে ব্যাপারে সচেতন থেকে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সকালে রাজধানীতে তথ্য ভবন নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। সরকারের উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর এবং চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড—এ ৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য রাজধানীর সার্কিট হাউজ রোডে নির্মিত হচ্ছে তথ্য ভবন। সকালে এই ভবনের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ষোল তলা তথ্য ভবনের নির্মাণকাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে যারা সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন, তাদের একহাত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক দমনে সচেতনতা বাড়াতে বেশি বেশি সংবাদ প্রচারে গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ জানান শেখ হাসিনা।

এ সময় সরকারের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত ও জনগণের কাছে সরকারের সেবা পৌঁছে দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে, ভুল এবং মানুষ ও সমাজের ক্ষতি করে এমন তথ্য যাতে কেউ না ছড়াতে পারে সেদিকে সজাগ থাকতে কর্মকর্তাদেরও নির্দেশ দেন তিনি।তথ্যের অবাধ প্রবাহে তার নেতৃত্বের সরকারই প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে অনুমোদন দেয় উল্লেখ করে, এখন সেসব টেলিভিশন চ্যানেলই সরকারের সমালোচনা করে বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।এ সময় গণতন্ত্র রক্ষা নিয়ে নাগরিক সমাজের নানা বক্তব্যেরও জবাব দেন শেখ হাসিনা।যারা এক সময় সেনা শাসকদের সঙ্গে ছিলেন, এখন গণতন্ত্রের বিকাশের কথা বলছেন, তাদের অতীত মনে করিয়ে দিয়ে সরকারপ্রধান জানতে চেয়েছেন, তখন তাদের চেতনার দুয়ার বন্ধ ছিল?মঙ্গলবার ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে নাগরিক সমাজের একদল নেতা আয়োজিত এক বৈঠকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন হওয়া জরুরি’ বলে মন্তব্য করেন একাধিক বক্তা। এজন্য সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিশন গঠনের তাগিদও দেওয়া হয় ওই বৈঠক থেকে।

বুধবার তথ্য ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে ওই বৈঠকের আলোচকদের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, যারা এই কথাগুলো বলেন, তাদের চেহারাগুলো যখন আমি দেখি.. এরাই একসময় .. ওই মিলিটারি ডিকটেটররা, যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, কেউ তাদের উপদেষ্টা হয়েছে, কেউ তাদের সাথে চাকরি করেছে, কেউ তাদের পদলেহন করেছেন, কেউ তাদের একটু করুণা ভিক্ষার জন্য ধর্না দিয়ে পড়ে থেকেছেন। তখন কিন্তু তাদের এই চেতনাগুলো ছিল না।মনে হচ্ছে, চেতনার দুয়ারটা যেন তখন বন্ধ ছিল। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যখন এসে উন্মুক্ত করে দিয়েছি, মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ করে দিয়েছি, তখন যেন ওনাদের বুদ্ধির দুয়ার এত খুলে যাচ্ছে .. যতই ওনারা গণতন্ত্র পাচ্ছেন, আরও চাই আরও চাই, করতে থাকেন।আর, এই আরও চাইয়ের যে ক্ষতিকারক দিকটা সেটা তারা চিন্তা করছে না। এটা করতে যেয়েই কিন্তু মাঝখানে আরেকটা ধাক্কা এসেছিল।

উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ওই বৈঠকে বিচারপতি লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ছিলেন। ২০০১ সালের ওই সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরাসরি অভিযোগ তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার আগে তিনি মহা হিসাব নিরীক্ষক ছিলেন।উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের আরেক সদস্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা ফখরুদ্দিন সরকারের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জানি, অনেকে আজকে আলোচনা করতে যেয়ে কেউ গণতন্ত্র নাকি দেখেনই না। কেউ সংবিধান সংশোধনের জন্য আবার কমিশন গঠনের কথা বলেন। কেউ নানাভাবে নানা কথা বলে।তিনি বলেন, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছি। এবং সেটাই করে যাচ্ছি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার মধ্যে প্রায় ১১ মাস বিশেষ কারাগারে বন্দি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী েেশখ হাসিনা। কারামুক্ত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসেন তিনি।সরকারের সমালোচকদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন যতটুকু সুযোগ পাচ্ছে, এদের চাহিদার মাত্রা আরও ততটুকু বেড়ে যাচ্ছে। ভালো।

চাহিদা থাকা ভালো। তাতে আমরা আপত্তি করব না। গণতন্ত্র আরও সুসংহত হোক। আরো বিকশিত হোক। কিন্তু আমরা রাষ্ট্র চালাচ্ছি। সকলেরই কথা বলার আধিকার আছে।কথা কিন্তু সকলে বলে যাচ্ছে। যার যা মনে আসছে, মুখে আসছে বলে যাচ্ছে।আওয়ামী লীগের শাসনামল ছাড়া কখনোই কেউ কথা বলার সুযোগ পায়নি দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, বলার সুযোগটা যে তারা পাচ্ছেন.. আমি আশা করি, যারা বলেন, তারা অন্তত বলার সময় এই কথাটুকু একটু মনে রাখবেন। ৯৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত কী অবস্থা ছিল? আর ২০০১ থেকে ২০০৮ বা ২০০৯ পর্যন্ত কী অবস্থা ছিল?কতটুকু বলতে পেরেছেন? সেটুকুও যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করেন এ পর্যন্ত ৩২টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ২৪টি এফএম বেতার কেন্দ্র এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও পরিচালনার অনুমোদন দেওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে একটা মাত্র চ্যানেল ছিল, তাও সরকারি। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন.. এটাতো আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। কোনো সরকার তো অতীতে এই সাহসই পায়নি। শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেন, আমার বেশ মজাই লাগে।

আমরাই দিলাম বেসরকারি টেলিভিশন। আর সেখানে বসে আমাদের সমালোচনাটাই যেন সব থেকে বেশি। সুযোগটা যে আমরা করে দিয়েছি, যারা বলেন- তারা মনে হয় মনে রাখেন না।তিনি বলেন, আমরা চেয়েছি, সমালোচনা হোক। সেই সমালোচনা গঠনমূলক হবে। সেই সমালোচনা যেন কেউ বিকৃত না করে। মানুষকে বিভ্রান্ত না করে।যতটুকু ভালো কাজ করেছি, সমালোচনার সাথে সাথে সেটুকুও বলার যেন সাহস থাকে। শেখ হাসিনা তার আধা ঘণ্টার বক্তব্যের একেবারে শেষদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্ম নিয়ে লেখালেখি প্রসঙ্গে কথা বলেন। সকলে যার যার ধর্ম নিয়ে চলবে। সকলের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে। কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কোনো কাজ করবে না বা বলবে না। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করবে। সেইভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই, বলেন তিনি। সম্প্রতি ব্লগার হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্যে লেখালেখিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আইজিপি একেএম শহীদুল হক সমালোচনার মুখে পড়েন।

বাংলাদেশে যেন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য এর খারাপ দিকগুলো নাগরিকদের সামনে তুলে ধরতে প্রচার মাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।এছাড়া মাদকের ক্ষতির দিকগুলো নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা এবং জনসচেতনতা তৈরির উপরও গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা। বেসরকারি টেলিভিশনের কর্ণধারদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজে বিত্তবান ব্যক্তি যারা আছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করে মোটা টাকা কামাই করছেন। তারা একটা টেলিভিশন কিনে নিয়ে বসে থাকলে আর ব্যবসার কথা চিন্তা করলে চলবে না।তার মাধ্যমে সমাজকে উন্নত করার, জনগণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেই সাথে সাথে আমরা বাঙালি। বাঙালি হিসাবে আমাদের যে চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি রয়েছে, শিক্ষা রয়েছে- সেগুলো আরও যাতে বিকশিত হয়। সে বিষয়গুলোর দিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।অনুষ্ঠানে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মালিক এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ এবং এশিয়ান টিভির মালিক হারুন অর রশিদ উপস্থিত ছিলেন। ৭৫ এর ১৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতা দখল করতে যেয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। স্বাধীনতার যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে, তাদেরকেই বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়।

২১ বছর বাংলাদেশের জনগণ বিকৃত ইতিহাস শুনেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেছে এবং পরাজিত শক্তির দাপটই ছিল এদেশে।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রজন্মের পর পর প্রজন্ম যাতে জানতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে বলেন শেখ হাসিনা। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।রাজধানীর সার্কিট হাউজ সড়কে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর চত্বরে এসে পৌঁছালে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তথ্য ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং জাতীয় সংসদে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতউল্লাহও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয়ে ১৬ তলা তথ্য ভবনের নির্মাণ কাজ ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হবে। এ ভবনে অফিস স্থাপনের পাশাপাশি আধুনিক লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, ফিল্ম প্রজেকশন হল, অডিটোরিয়াম, ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার থাকবে।হাসানুল হক ইনু তার বক্তব্যে বলেন, তথ্যই হচ্ছে শক্তি। তথ্য সকলের মুখোশ খুলে দেয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা তথ্য দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়ন করছেন।চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। তথ্য সচিব মরতুজা আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও এ কে এম রহমতউল্লাহ বক্তব্য দেন।