মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানি ৯ ফেব্র“য়ারি

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী সুপ্রিমকোর্টের আপিলেও মৃত্যুদন্ড বহালের রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন দাখিল করেছেন।রোববার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় তার আইনজীবীরা এই আবেদন জমা দেন।

রিভিউতে ৮৬ পৃষ্ঠার আবেদনে তারা ১৪টি যুক্তি দেখিয়ে মীর কাসেমকে ফাঁসির দন্ড থেকে অব্যাহতি চেয়ে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করেছে। মীর কাসেমের আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাসেম আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদনটি দাখিল করেন বলে জানান।মীর কাসেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম পরে বলেন, যেসব অভিযোগে দন্ড দেওয়া হয়েছে, সেগুলো থেকে অব্যাহতি চেয়ে এই আবেদন করা হয়েছে।

এর আগে গত ৬ জুন দুই শত ৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ পায়। নিয়ম অনুয়ায়ি পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে সংক্ষদ্ধ পক্ষ রিভিউ করতে পারে। সে হিসেবে নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই তারা রিভিউ (পুনঃবিবেচনা) আবেদন করেছেন।ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর আপিল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ।আপিলের রায়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে এক অভিযোগে মৃত্যুদন্ড এবং আরও ছয় অভিযোগে ৫৮ বছর কারাদন্ডের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে হত্যার দায় থেকে এই জামায়াত নেতা অব্যাহতি পেলেও ১১ নম্বর অভিযোগ সর্বোচ্চ সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদন্ড এবং আট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদন্ড হয়েছিল। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও এই ব্যবসায়ীকে। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার বিচার। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় । তার বিরুদ্ধে আনীত ১৪টি অভিযোগের মধ্যে মীর কাসেমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আর ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে আপিল নাকচ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ই বহাল রাখা হয়েছে ।২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়েও বহাল থাকে সেই সাজা।বিচারকরা সই করার পর ৬ জুন ২৪৪ পৃষ্ঠার সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। তা হাতে পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসামির বিরুদ্ধে জারি করে মৃত্যু পরোয়ানা, যার মধ্য দিয়ে সাজা কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরুর পথ তৈরি হয়।

লাল সালুতে মোড়া সেই পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘুরে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়। ৭ জুন তা পড়ে শোনানো হয় ফাঁসির আসামি মীর কাসেমকে পড়ে শোনানো হলে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিনের দিন গণনা।নিয়ম অনুযায়ী, আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পায়। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দ- কার্যকর করা যায় না।রিভিউ না টিকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা তিনি চাইতে পারবেন একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম। সে আর্জিও নাকচ হলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ দ- কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে। তার আগে আসামির সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন।

রিভিউ আবেদন দাখিলের পর কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৮৬ পৃষ্ঠার আবেদনে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরেছেন তারা।১১ নম্বর চার্জে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। রিভিউয়ে ন্যায়বিচার পাব বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।খন্দকার মাহবুব দাবি করেন, মীর কাসেম রাজনীতিবিদ ‘ছিলেন না’। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক’।মীর কাসেমের ছেলে আহমেদ বিন কাসেম, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও এম মাসুদ রানা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়। আপিলেও তা বহাল থাকে।এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদ-ের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার। এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ ৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে।ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময়।ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী তিনি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের’ দোষে দোষী। ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।