জমকালো উদ্বোধনে পর্দা উঠলো রিও অলিম্পিকের

আ মুন্দ ভিভো বা নতুন বিশ্ব উপহার দেওয়ার স্লোগান নিয়ে পর্দা উঠলো অলিম্পিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। ব্রাজিলের স্থানীয় সময় রাত ৮টায় বাংলাদেশের স্থানীয় সময় শনিবার ভোর ৫টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিক চলবে ২১ আগস্ট পর্যন্ত। ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্রাজিল। জমকালো এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি দেখতে প্রায় ৭৮ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন স্টেডিয়ামে। আর টিভিতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের চোখ ছিল এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার জন্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে পতাকা হাতে দেশসেরা অ্যাথলেটদের মার্চপাস্ট চোখে পড়ে।

গত কয়েকটি অলিম্পিকের মতো চাকচিক্য ছিল না; উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট বরাদ্দও ছিল কম। তাই আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্ভর না করে সাম্বা, বোসা নোভা আর ফাংকের তালে ব্রাজিলের ঐতিহ্য, রেইনফরেস্ট আর বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উপস্থাপন করা হলো বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া উৎসবের।রিও দে জেনেইরোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিল না ২০০৮ সালের বেইজিং আর ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। ব্যয়বহুল প্রযুক্তি কম ব্যবহার করে আয়োজকরা ভরসা করেছেন ব্রাজিলের মেধাবী শিল্পী আর কার্নিভাল সংস্কৃতির উপর।

বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর ৫ টায় নাচ দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এরপর কোরিওগ্রাফে তুলে ধরা হয় ব্রাজিলের রেইনফরেস্ট আর আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে। তুলে ধরা হয় প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে পর্তুগিজরা পা রাখার পর থেকে ব্রাজিলের পথচলা। উদযাপন করা হয় দেশটির ইতিহাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।ব্রাজিল বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি টিভি দর্শককে আহ্বান জানাল পৃথিবীর যতœ নিতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট আমাজন রক্ষারও আবেদন এল।এক দফা আতশবাজির উৎসবের পর মাঠে আসেন অ্যাথলেটরা। ২০৭টি দলের অ্যাথলেট প্যারেডে সবার আগে আসে অলিম্পিকের সূতিকাগার গ্রিস। এরপর বর্ণানুক্রমে আগে আসে আফগানিস্তান। সবার শেষে ব্রাজিল।

স্বাগতিকদের আগে ২০৬ নম্বর দল হিসেবে স্টেডিয়ামে আসে অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গঠিত উদ্বাস্তুদের দল। গৃহ থেকে উচ্ছেদ হওয়া এই অ্যাথলেটরা খেলছেন অলিম্পিক পতাকা নিয়ে। ব্রাজিলের পর এই দলই সবচেয়ে বেশি অভিনন্দন পেয়েছে স্টেডিয়ামের প্রায় ৬০ হাজার দর্শকের কাছ থেকে।বাংলাদেশের পতাকা ছিল অলিম্পিকে সরাসরি অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা প্রথম বাংলাদেশি অ্যাথলেট সিদ্দিকুর রহমানের হাতে। গলফে অলিম্পিক পদকের জন্য লড়বেন তিনি, যে পদক জয়ের সম্ভাবনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কেউ তৈরি করতে পারেনি।ব্রাজিলের অন্তর্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে প্রথম অলিম্পিকের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। কিন্তু তার বক্তব্যের সময় দর্শকদের কিছু অংশ থেকে দুয়োধ্বনিও শোনা গেল।

অলিম্পিক মশাল স্টেডিয়ামে বহন করে আনেন ব্রাজিলের সাবেক টেনিস খেলোয়াড় তিন বারের ফরাসি ওপেন জয়ী গুস্তাভো কুয়ের্তেন।অলিম্পিকের মূল মশালটা প্রজ্বলিত করেন ম্যারাথন দৌড়বিদ এথেন্স অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ভানদেরলেই দি লিমা। আকাশ আলোকিত করা আতশবাজির উৎসবে শেষ হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।অলিম্পিকের ৩১তম আয়োজনে অংশ নিয়েছে ২০৭টি দেশ ও দল। অংশ নিচ্ছেন ১১ হাজারের বেশি অ্যাথলেট। ২৮টি ক্রীড়ার ৩০৬টি ইভেন্টে পদকের জন্য লড়বেন তারা।আয়োজকরা আশা করছেন, অলিম্পিক উপলক্ষে আসবেন ৫ লাখেরও বেশি পর্যটক। তবে উদ্বোধনের আগের দিন পর্যন্ত মোট ৭৫ লাখ টিকেটের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি টিকেট অবিক্রিত রয়ে গেছে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অলিম্পিকে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অলিম্পিকের বিভিন্ন ভেন্যু, অলিম্পিক ভিলেজ, বিমানবন্দর ও প্রধান সড়কগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে প্রায় ৫৫টি দেশের ৮৫ হাজার নিরাপত্তাকর্মী, যা লন্ডনে ২০১২ অলিম্পিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
আইওসি সভাপতি বাখ স্বভাবতই ইতিবাচক রিও অলিম্পিক নিয়ে।

ব্রাজিলের সবাই আজকে রাতের জন্য গর্বিত থাকতে পারেন।ৃ আপনারা রিও দে জেনেইরোকে একটি আধুনিক নগরে পরিণত করেছেন। ব্রাজিলের ইতিহাসের খুবই কঠিন সময়ে আপনারা এটা করেছেন। আমরা সব সময়ই আপনাদের উপর বিশ্বাস রেখেছি।রিও ২০১৬ -এর সভাপতি কার্লোস নুসমান জানালেন, তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ‘সুখী মানুষ’।আয়োজকরা তো ইতিবাচক থাকবেনই; সত্যিটা হলো, অর্থনৈতিক মন্দা আর রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ব্রাজিলের ইতিহাসের এক সংকটময় সময়েই হচ্ছে এই অলিম্পিক। বুধবার রিওতে অলিম্পিক মশাল পৌঁছানোর অনুষ্ঠানেও হয়েছে বিক্ষোভ। আছে জিকা ভাইরাসেরও হুমকি, যে জন্য ব্রাজিলে আসেননি বেশ কিছু তারকা অ্যাথলেট।

আছে ডোপিং কেলেংকারি নিয়ে বিতর্ক। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অবকাঠামো আর কিছু ভেন্যু নিয়েও আপত্তি উঠেছে।আয়োজনে কিছু ঘাটতি আর অনেক সমস্যা মাথায় নিয়েও পাশের কোরকোভাদো পাহাড়ের উপরে হাত বাড়িয়ে থাকা ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের মতো রিও দে জেনেইরোও উৎসবে যোগ দিতে স্বাগত জানাচ্ছে বিশ্ববাসীকে।জিকা আতঙ্ক, অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে রিও ডি জেনিরোতে শুরু হলো রিও অলিম্পিক।২০১২ সালের অলিম্পিককেও ছাড়িয়ে যাবে এবারের আসর-এমনটি আগেই ঘোষণা দিয়েছিল আয়োজক দেশটি। তারই কিছু চিত্রের দেখা মেলে উদ্বোধনীতে।

আয়োজনের বড় একটি অংশ জুড়ে ছিল ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাম্বা স্কুলের প্রায় ছয় হাজার নৃত্যশিল্পী বিশেষ পোশাকে নৃত্যের মায়াজালে মোহিত করে রাখেন দর্শকদের। ১২০ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে কখনোই অ্যাথলেটিক্স মাঠের বাইরে হয়নি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এই প্রথম অলিম্পিকের উদ্বোধন হলো ফুটবলের স্টেডিয়াম মারাকানায়।অলিম্পিকের ৩১তম এই আয়োজনে অংশ নিয়েছে ২০৬টি দেশ। যেখানে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি অ্যাথলেট অংশ নেবেন। মোট ২৮টি ক্রীড়া ইভেন্টে ৩০৬টি পদকের জন্য লড়বে দেশসেরা এই অ্যাথলেটরা।ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী সাম্বা নৃত্য তো ছিলই, ছিল বিশ্বের সব থেকে দামি সুপারমডেল ব্রাজিলের জিসেল বুন্দচেন। তার ক্যাটওয়াকের সঙ্গে বড় একটি অংশ জুড়ে ছিল তৃতীয় লিঙ্গের ব্রাজিলিয়ান মডেল লি টির পরিবেশনা।অলিম্পিকের ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মডেলের উপস্থিতি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও ছিল ভিন্নধর্মী নানা আয়োজন। আয়োজক দেশ ব্রাজিল তাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর কাছে। ছিল আমাজনের অরণ্য ব্রাজিলের জন্য বিশাল গৌরবের বিষয়। আমাজনকে ফুটিয়ে তুলতে আরও ছিল বানর, ম্যাকাউ পাখি ও বৃষ্টির শব্দ।

অনুষ্ঠানে গান গেয়ে দর্শকদের মন মাতান ব্রাজিলের বিখ্যাত সব সঙ্গীত শিল্পীরা। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’র মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় ব্রাজিলের পর্তুগীজ উপনিবেশের ইতিহাস। সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশটির খ্যাতিমান শিল্পী অ্যানিত্তা, কায়েতোনো ও গিলবার্তো গিল।অনুষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক ফার্নান্দো মেয়ারলেস। তার সঙ্গে ছিলেন আন্দুচা ওয়াশিংটন এবং ড্যানিয়েলা থমাস।