নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের প্রচারণার আর মাত্র দুই দিন বাকি। মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীরাও গণসংযোগ আর প্রচারণায় রাতদিন চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী এলাকা। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের কেউ কেউ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।তারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন কঠোর থাকলে গতবারের মত এবারও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে ২২ প্লাটুন বিজিবি মাঠে নামছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ১৭৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩৭টিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বিবেচেনা করে ভোটের নিরাপত্তা সাজাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। রাজধানীর লাগোয়া এই শিল্প নগরীতে আগামী বৃহস্পতিবার ভোট সামনে রেখে সোমবার মাঠে নামছে ২২ প্লাটুন বিজিবি। অন্য এলাকার বাসিন্দাদের নারায়ণগঞ্জে অবস্থানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে সোমবার মধ্যরাত থেকে।রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলছেন, সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে পুরো শহর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা।নগরীর ১৭৪টি কেন্দ্রের প্রতিটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪ জন করে সদস্য থাকবেন। তবে ১৩৭টি ভোটকেন্দ্রে ‘বিশেষ নজর’ রাখা হবে।নাসিক নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থীদের প্রচারণার তোড়জোড়ও বাড়ছে সমান তালে। দিনরাত পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন তারাÑ চাইছেন ভোট। তবে অধিকাংশ কাউন্সিলর প্রার্থীর অভিযোগ প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীরা তাদের পোষ্টার ছিড়ে ফেলছেন।

প্রচারণায় কর্মীদের বাধা দেয়াসহ কেন্দ্র দখলের হুমকিও দিচ্ছেন অনেকে। এসব কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন অনেক প্রার্থীই।পুলিশ সুপার মঈনুল ইসলাম বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল রয়েছে।নির্বাচনে নিয়োজিত পুলিশ র্যা ব বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সবদিকে খেয়াল রেখে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।এদিকে, ১৯ ডিসেম্বর রাত বারোটা থেকে নারায়ণগঞ্জে মোটর সাইকেল চলাচলসহ বহিরাগত আগমন বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন আর প্রচারণা চালানো যাবে ২০ ডিসেম্বর রাত বারোটা পর্যন্ত।

রোববার আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেলের বৈঠক শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, এবার নারায়ণগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ৫৬০০ সদস্য মাঠে থাকবে।… ১৩৭টি কেন্দ্রের তালিকা পেয়েছি একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে। এগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হবে।ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে যে কোনো সময় ‘পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে’, তা মাথায় রেখে ‘গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে’ টহল জোরদার করা হবে বলে জানান ইসির এ উপ সচিব।রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ নির্বাচনের ৭৯ শতাংশ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কেন্দ্রে গোলযোগের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হতে পারে।প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারের জন্য নারায়ণগঞ্জে আসা বহিরাগতদের এলাকা ছাড়তে হবে সোমবার মধ্যরাতেই। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে নিষিদ্ধ হবে সব ধরনের প্রচার।রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, আমরা মাইকে প্রচারণার শেষ সময় স্মরণ করে দিতে বলব। ভোটের আগে ৩২ ঘণ্টা সব ধরনের মিছিল, জনসভাসহ প্রচার নিষিদ্ধ থাকবে।বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে এলেও নুরুজ্জামান নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তার ‘দরকার পড়বে না। সোমবার বিজিবি, মঙ্গলবার র‌্যাব, বুধবার পুলিশ, এপিবিএন, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী মাঠে নামবে। শিল্প পুলিশও থাকবে মাঠে। কেন্দ্রে যেখানেই ঝামেলা হবে, সেখানে অভিযোগকারীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যাবে টহল টিম।নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ‘কঠোর’ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ সদস্য থাকবে। যে কোনো অনিয়ম হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিতে বলেছি।মেয়র পদের ৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের ৩৮ জন প্রার্থী।২৭টি ওয়ার্ডে ১৭৪টি কেন্দ্র, ভোটকক্ষ ১ হাজার ৩০৪টি২২ ডিসেম্বর ভোট। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ ।

নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্ধদার বৈঠক করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন কৌশল নির্ধারণ নিয়ে মূলত এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।ইসি কর্মকর্তারা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাকে ‘বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’ বিবেচনা করে সেখানে ‘বাড়তি ফোর্স’ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। যে ২২ প্লাটুন বিজিবি সদস্েযর নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনের কথা রয়েছে, তার মধ্যে ১০ প্লাটুনই থাকবে সিদ্ধিরগঞ্জে। তারা দুটি স্থানে অবস্থান নিয়ে টহলে থাকবেন। এছাড়া শহর এলাকায় সাত প্লাটুন ও বন্দর এলাকায় পাঁচ প্লাটুন বিজিবি থাকবে।মঙ্গলবার র‌্যাবের ২৭টি মোবাটিমটীম মাঠে নামবে। প্রতিটি দলে থাকবেন ১২ জন করে। প্রতিটি ওয়ার্ডে পুলিশের তিনটি করে মোট ৮১টি টিম টহলে থাকবে। প্রতিটি টিমের সদস্য সংখ্যা হবে ১২ জন।

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈঠকে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ভোটের সময় শিল্প পুলিশের ২০০ জন সদস্য জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেবেন বলে ইসি কর্মকর্তারা জানান।

তারা বলছেন, ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্ত্রসহ সাতজন পুলিশ, অস্ত্রসহ তিনজন ব্যাটালিয়ন আনসার, অঙ্গীভূত আনসার/ভিডিপর ১৪ সদস্যসহ মোট ২৪ জন থাকবেন প্রতিটি কেন্দ্রে।২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৫ ডিসেম্বর থেকে মাঠে রয়েছেন নির্বাহী হাকিম। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে ভোটের দিন আরও নয় জন যোগ হবেন। তখন ১৪ জন বিচারিক হাকিম মাঠে থাকবেন। এদিকে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ভোটারদের নিঃসংকোচে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ।পাশাপাশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নারায়ণগঞ্জে সুন্দর নির্বাচন উপহার দেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।সোমবার নিজের কার্যালয়ে এ নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, কেউ যদি কোনো গোলমাল করার চেষ্টা করে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সবাই দেখবে নির্বাচনটায় আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি এবং অভিজ্ঞতার ভা-ার উজাড় করে দিয়ে আমরা একটা সুন্দর নির্বাচন করছি।আগামী ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ভোট চলবে।এক প্রশ্নের জবাবে শাহনেওয়াজ জানান, ভোট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিরা শঙ্কা করতেই পারেন।

মানুষের মনে শঙ্কা আসতেই পারে। তবে কমিশন সার্বিকভাবে ভালো নির্বাচনের জন্য যত ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সবই ব্যবস্থা নেবে।গতবারও অনেক শঙ্কা করা হয়েছিল, কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। এবারও আলাদা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সবার জন্যে নির্বিঘœ পরিবেশ নিশ্চিত করছি আমরা। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য বাড়ানো হবে, তৎপরতাও বাড়ানো হবে।

নির্বিঘেœ নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন সম্পন্ন করতে কমিশনের শক্ত অবস্থানে থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো গোলমাল ও অনিয়ম সহ্য করা হবে না। আমরা শঙ্কার অবস্থানে নেই; নিঃসংকোচে সবাইকে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ভোটারদের আহ্বান জানাই-আপনার ভীত হবেন না, নির্বিঘেœ ভোট দিতে আসবেন।এ নির্বাচন কমিশনার জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সোমবার থেকে নারায়ণগঞ্জে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে; প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্বাহী হাকিম থাকবেন।ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানানা।