প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সশস্ত্রবাহিনীসহ সকলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার চায় না, দেশে এমন কিছু ঘটুক যাতে চলমান উন্নয়নে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। কাজেই আমরা চাই না যে, এখানে এমন কিছু ঘটুক যাতে আমাদের চলমান উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) ২০১৬-২০১৭ কোর্সের গ্রাজুয়েশন প্রদান উপলক্ষে মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয় এখন বিশ্বব্যাপীই একটি উদ্বেগজনক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে তাঁর সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে সরকার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদসদেরও এই গণসচেতনতা সৃষ্টির কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্রবাহিনীরও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় সমাজের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানান তারা যেন নিজ নিজ সন্তান সন্ততির দিকে ঠিকমত খেয়াল রাখেন যাতে করে কেউ আর এই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদকাশক্তির পথে পা বাড়াতে না পারে।সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একইসঙ্গে মানুষকে এর ক্ষতির দিক সম্পর্কে বোঝাতে হবে।অনুষ্ঠানে ডিএসসিএসসি’র কমানডেন্ট মেজর জেনারেল মো. শফিউল আবেদীন স্বাগত বক্তৃতা করেন।মন্ত্রিপরিষদ সদসবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদসবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ, কূটনিতিকবৃন্দ, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামারক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

দেশের ভৌগলিক অবস্থানকে অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্রবাহিনীসহ সকলকে এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করে যেতে হবে।তিনি বলেন, আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, দেশের ভৌগলিক অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদেরকেই এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।সবাইকে এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ায় ব্রতী হবার ও আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যেন মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পায়।এ সময় আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আর কেউ যেন কখনো অবহেলা করতে না পারে।যে উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে তাকে অব্যাহত রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যাতে বিশ্বসভায় আমরা মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলতে পারি, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী এ সময় সশস্ত্রবাহিনীসহ সকলকে কর্তব্যনিষ্ঠভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালনের আহবান জানিয়ে বলেন,আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেই বিজয় অর্জন করেছি। কাজেই আমরা সবসময় মাথা উঁচু করে চলব, মাথা নিচু করে নয়। কথাটা সবসময় মনে রাখতে হবে, বিশেষ করে নবীন অফিসারদের।সশস্ত্র বাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূর্ত প্রতীক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকবিলায়ও প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন।দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম, অবকাঠামো নির্মাণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অসামরিক প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসছেন,বলেন প্রধানমন্ত্রী।শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রশংসা ও সুনাম অর্জন করেছে।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা, গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ, সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনাসহ পুনর্গঠন কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাঁদের সাফল্যে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনী একটি দেশের জাতীয় সম্পদ এবং জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের একটি অন্যতম উপাদান। এই উপলব্ধি থেকেই জাতির পিতা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একটি সুশৃঙ্খল ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৬৬ সালেই তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফায় পূর্ব বাংলায় নৌ-বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপনের দাবি উত্থাপন করেন।আমাদের জলসীমায় ব্লু ইকোনমি’র সম্ভাবনা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদালতে আইনী প্রক্রিয়ায় জয়লাভ করে বিশাল সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাময় দুয়ার।আমরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নৌ-বাহিনীকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও আমাদের নৌবাহিনীর সাবমেরিন ছিল না। সাম্প্রতিক অত্যাধুনিক সাবমেরিন যুদ্ধ জাহাজ নৌ বাহিনীতে যুক্ত হয়ে আমাদের সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়েছে। আক্ষরিকভাবেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আওতায় আমরা একইভাবে সেনা ও বিমান বাহিনীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ এবং চৌকস ও পেশাদারভাবে গড়ে তুলছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমানসহ হেলিকপ্টার ও অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র।

শেখ হাসিনা বলেন, বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে নতুন নতুন ইউনিট, বৃদ্ধি পেয়েছে জনবল। অনুমোদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু এ্যারোনটিক্যাল সেন্টার এবং পূর্ণাঙ্গ ঘাঁটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধু ও কক্সবাজার বিমান ঘাঁটি।সরকার প্রধান বলেন, সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে নতুন সংযোজিত ট্যাংক, এপিসি, সেল্ফ প্রোপেলড আর্টিলারী গান, ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল এর পরিচালনায় পারদর্শিতা, মেইনটেন্যান্স কাজে পেশাদারিত্ব ও সেনাবাহিনীর সার্বিক সক্ষমতায় আমরা সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারি।প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনীর আধুকিায়নের প্রসংগ তুলে ধরে বলেন, সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজের অবকাঠামোগত সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমাদের সরকার ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় স্টাফ কলেজের বহুতল একাডেমিক ভবনসহ আরও কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।

তিনি বলেন, শুরু থেকে এ পর্যন্ত স্টাফ কলেজে সেনাবাহিনীর ৪১টি, নৌ-বাহিনীর ৩৫টি এবং বিমান বাহিনীর ৩৭টি স্টাফ কোর্স সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে ৪০টি বন্ধুপ্রতীম দেশের ৯৯৮ জন অফিসারও এ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তারা সকলেই নিজ নিজ দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।তিনি বলেন, আমাদের স্টাফ কলেজের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে আমি মনে করি। এই সাফল্যের জন্য আমি কলেজের সাবেক ও বর্তমান কমান্ড্যান্ট, অনুষদ সদস্যবৃন্দ ও সকল অফিসারকে জানাই আমার অভিনন্দন।

নবীন গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের দিনটি নিঃসন্দেহে আপনাদের জীবনের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি দিন। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আজ আপনারা সমর বিজ্ঞানের উপর উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেছেন। আমার বিশ্বাস, এ প্রশিক্ষণ অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালনে এবং যেকোন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাদের আরো আত্মপ্রত্যয়ী হতে শেখাবে।শুধু তাই নয়, এখন থেকে আরও বড় ধরণের নেতৃত্ব প্রদানে আপনারা নিজেদের প্রস্তুত রাখবেন বলেও আমি বিশ্বাস করি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এ বছর মোট ১৪ জন মহিলা অফিসার গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। প্রতিবছর মহিলা অফিসারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সশস্ত্র বাহিনী তথা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের দিক-নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।তিনি গ্রাজুয়েট এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পারিবারিক জীবন সুখ ও স্বাচ্ছন্দময় হবার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত যে, গ্র্যাজুয়েট অফিসারদের সহধর্মিণীগণ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন গঠনমূলক ও সামাজিক কর্মকান্ডে সমানভাবে অংশ নিয়েছেন।এরআগে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ডিএনসিএসসি’র ২০১৬-১৭ কোর্সের গ্রাজুয়েটদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করেন।এবছর ২৮০ জন কর্মকর্তা গ্রজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। যারমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫৮ জন, নৌবাহিনীর ২৭ জন.বিমানবাহিনীর ২৪ জন এবং ৭১ জন বিদেশ থেকে আগত সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য রয়েছেন।