মিঃ নটের শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছিল না। কেমন যেন একটা ব্যাথা তিনি অনুভব করেন বুকের বাম দিকে। তবে খুব বেশি না ব্যাথাটা। বেশী না হলেও এর মধ্যে তিনি দু’টো ডাক্তার দেখিয়ে এসেছেন। এম আর এ এবং এম আর আই দু’টোই করিয়েছেন তার মাথার। এছাড়া আরও দু’টো পরীক্ষা করিয়েছেন, ব্যালেন্স টেস্ট অ্যান্ড ডপলার টেস্ট না কি বলে যেন সেটা। ব্যাপারটা অত হাল্কা নয় বলে তিনি মনে করেন। কারণ তিনি যখন বসে টিভি দেখেন বা কম্পিটারে কাজ করেন, তখন হঠাৎ করে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সর্বনাশ, একি কথা…তাহ’লে তার কথাগুলো কিভাবে প্রকাশ করবেন যদি তিনি পড়ে গিয়ে ভীষণ আঘাত পান বা মরেই যান, আল্লাহ্‌ (বা সৃষ্টিকর্তা) না করুন। যাহোক, আজ সকাল থেকে তিনি বেশ ভাল বোধ করছেন এবং নিজেকে বললেন, ‘আজ আমি কিছু কথা বলবই আমার পাঠকদের জন্যে’। বলতে না বলতে কম্পিটারে বসে থাকা মিঃ নট দেখলেন ফেস বুকের পাতায় ইমরুল একটা তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠিয়েছে। ইমরুল তার দীর্ঘদিনের বন্ধু, একেবারে যাকে বলে ‘বাচুবান্দ কা দোস্‌ত্‌’।

ইমরুলঃ নট, তুই চলে আয় আমার এখানে…
মিঃ নটঃ কেন?
ইমরুলঃ ক্রিকেট খেলা দেখব সবাই মিলে বড় পর্দার টিভিতে। ভারতীয় চ্যানেল স্টার স্পোর্টস সরাসরি ঢাকা মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে প্রচার করবে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা, টামিমের সেঞ্ছুরী দেখব আমরা।
মিঃ নটঃ তাই নাকি, তো বড় পর্দা আমারও আছে, না হয় তুই আয় আমার এখানে।
ইমরুলঃ আরে, আমার এখানে আড্ডাটা ভাল জমবে, এখানে আরও ৫/৬ জন মানুষ আছে। পাশের বাসার জাকির ভাই আর ভাবীও আসবে তাদের দু’টো বাচ্চাসহ। আর বাংলাদেশ থেকে আমার মামাতো বোন ও তার স্বামী এসেছে নতুন অভিবাসী হয়ে। আপাততঃ আমাদের এখানে উঠেছে। তুই চলে আয় ভাবী-বাচ্চাদের নিয়ে।
মিঃ নটঃ আরে, আমার তো ৫টা বাচ্চা, বেশী ঝামেলা হবে না?
ইমরুলঃ না, না, মোটেও না। তুই চলে আয়।
মিঃ নটঃ আচ্ছা, আসছি তাহলে……
একথা বলতে বলতে মিঃ নটের মাথায় একটা বিষয় খেলে গেল। ওখানে যেহেতু প্রায় ৭/৮ জন মানুষ একসাথে হবে, তো সেখানে কিছু গণতন্ত্রের কথা বলা যাবে। কিন্তু ওরা তো খেলা দেখবে, সেটা কি ভাল সময় হ’ল? ফাঁকে ফাঁকে যখন বিজ্ঞাপন প্রচার করে সে সময় বা চা খেতে খেতে বলা যাবে। এ কথা ভেবে মিঃ নট বেশ পুলকিত বোধ করলেন যে কিছু কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে সেখানে। ইদানীং মিঃ নটের যে কি হয়েছে, শুধু কথা বলতে চান মানুষের সাথে। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না মিঃ নট। সময় মত গিয়ে হাজির সেখানে। ১৫ মিনিট হাঁটার পথ ইমরুলের বাসা। দিনটা ভালোই যাবে মনে হচ্ছে।

ইমরুলের বাসার ড্রয়িং রুমটা বেশ বড়। কমপক্ষে ১৫/১৬ জন লোক বসতে পারে। আগে থেকেই ইমরুল ভাবী গুছিয়ে রেখেছেন। একের পর এক চা-কফি, প্রাতঃরাশের নানা প্রকার খাবার-দাবার টেবিলে আস্তে লাগলো। এর মধ্যে সবাই এসে হাজির। ইমরুল প্রথমে নিজের পরিচয় দিল। বলল, ‘আমি ইমরুল। আমি নিউ ইয়র্ক সিটি গভঃ এ কাজ করি। সিটি কমিশন অন হিউম্যান রাইটস। আর এ হচ্ছে আমার স্ত্রী সিমি নাহ্‌রীন (সিমি), ও আমাদের বাঙ্গালী কমিউনিটিতে কমিউনিটি আয়োজক হিসেবে কাজ করে নিউ ইয়র্ক সিটি বোর্ড অব এডুকেশনে। এরপর ইমরুল ওর মামাতো বোনকে এবং তার স্বামীকে পরিচয় করিয়ে দিল। বোনের নাম গুলশান আরা। নিজে সারাজীবন রাজনীতি করেছেন আবার পেশায় ওকালতিও করেছেন। ২০০৯ সালের আওয়ামীলিগ সরকারের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রীও ছিলেন। বোনটি তার বেশ প্রভাবশালী বুঝাই যায়। বোনের জামাই কাজী হাবিব একজন সাধাসিধে সাংবাদিক মানুষ। উনি কম কথা বলেন এবং গণতন্ত্র নিয়ে বেশ লেখালেখি করেন পত্রিকায়। টক শোতেও তাকে বেশ সোচ্চার দেখা যায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল গুলোতে। এরপর ইমরুল ওদের পাশের বাসার জাকির ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন বিত্তশালী আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে, যিনি বিয়ে করেছেন একজন ইটালীয় বংশোদ্ভুত সুশ্রী মহিলাকে যিনি জাকির ভাইয়ের ব্যবসায়িক অংশীদার। এরপর ইমরুল মিঃ নটের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, নট, তুই এবার নিজেকে তুলে ধর সবার কাছে। মনে হয় ইমরুল ক্লান্ত হয়ে গেছে।

মিঃ নট বলতে শুরু করলেন এভাবে। আমি নট। আমি মূলত একটি শক্ত ও জটিল গ্রন্থির বিমূর্তকরণ মাত্র । আমার বিচরণক্ষেত্র তামাম দুনিয়াব্যাপী।যদিও আমি বাংলাদেশ জন্মেছি, সারা পৃথিবীই আমার ভাবনার ক্ষেত্র। আমি মূলতঃ বাংলাদেশ, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর বিভিন্ন ধরণের জটিল ইস্যু বা সমসা নিয়ে গভীর চিন্তা করে থাকি। এজন্যে মানুষ আমার নাম দিয়েছে মিঃ নট। তারপরে যার সাথে দেখা হয় তাকেই কিছু বলার চেষ্টা করি, সাক্ষাতে, ফোনে, ভিডিও কলে ইত্যাদি। বিশেষ করে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। জন্মেছি যে দেশে, খেয়ে-দেয়ে বড় হয়েছি, এগুলো নিয়ে তো আমাকে ভাবতেই হবে। যেমনঃ খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে কথা বলবো ভাবছি। আপনারা সবাই আমার সাথে যে যা জানেন বা যার যা অভিজ্ঞতা আছে, তা ভাগাভাগি করবেন।

এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে খেলা। টসে হেরেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান ব্যাট করতে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ দলকে। টামিম আর মাহ্‌মুদুল উদ্‌বোধনী জুটি। কপাল খারাপ আজ তামিমের, শূন্য রানে দু’ বল খেলেই আউট। গ্যালারীতে নিরুত্তাপ ভাব দেখছি, আমাদের ঘরের গ্যালারীতেও তার ব্যতিক্রম নয়। এর পর ছাকিব হোছাইন নেমেই মারল একটা ছক্কা। আর যায় কই। গ্যালারীর তাপ যেন এসে পড়লো ইমরুলের ড্রয়িং রুমে। সেই সাথে ওর স্ত্রী সিমির তৈরী করা সদ্য ভাজা সামুছা ও সিঙ্গারা যেন ডবল ছক্কার আমেজ তৈরী করল। উত্তাপ একটু কমতেই মিঃ নট কাজী হাবিব কে বলল, কাজী ভাই কবে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে?

কাজীঃ তিন দিন হ’ল
মিঃ নটঃ আচ্ছা, কাজী ভাই, আপনি তো গণতন্ত্র নিয়ে, মানুষের অধিকার নিয়ে বেশ লেখালেখি করেন, আবার টক-শোতেও কথা বলেন যা অনেক সময় আমি এখানে বসেও দেখি। (আমাদের কথা গুলো সবাই বেশ কান খাড়া করে শুনছেন, আবার খেলাও দেখছেন)
কাজীঃ আর বলেন না, বাংলাদেশে এসবের চর্চা হবে না ভাই। ওখানে গণতন্ত্র বুঝার লোকের সংখ্যাই কম। যারা বুঝেন, তারাও বুঝতে চান না বা বুঝলেও কিছু করতে পারেন না। অনেকে বলে গণতন্ত্র বাংলাদেশের জন্যে প্রযোজ্য নয়, ওদের জন্যে দরকার ডান্ডা আর লাঠি-পেটা। কথাই তো আছে, ডান্ডার আগায় সব ঠান্ডা।
মিঃ নটঃ ছিঃ ছিঃ কাজী ভাই, কি বলেন এসব। তাহলে কি আমরা সভ্য হব না? সভ্যতার চর্চা করব না? আইন ও অধিকারের চর্চা করবো না? (আমাদের কথা শুনে কাজী ভাইয়ের স্ত্রী গুলশান আরা রেগেই গেলেন)
গুলশানঃ আরে ভাই নট, কি বলেন এসব? আমি মন্ত্রী ছিলাম, আমার হুকুমেই তো সব চালিয়েছি। আইন-টাইন কি আছে নাই ওসব নিয়ে আমার মাথা ব্যথা ছিল না। আইন আমরা তৈরী করতে পারি। আমরা যা বলব তাই আইন।
মিঃ নটঃ আইন তো আইন পরিষদ বা আদালত (কেস ল’) তৈরী করে? তাই আমি জানি। কিভাবে আপনি আইন তৈরী করতেন, মন্ত্রী তো আইন তৈরী করে না, আইন পালন বা প্রয়োগ করে?
গুলশানঃ কেন ঐ যে নোটিং…?
মিঃ নটঃ নোটিং বলতে……?
গুলশানঃ নোটিং জানেন না আপনি? আপনি তো বাংলাদেশের সব ভুলে গেছেন মনে হচ্ছে? নোটিং হল এমন একটি পদ্ধতি যা ৭ (সাত) ধাপ পেরিয়ে বহু চিন্তা-বিশ্লেষন করে, অনেক সাদা কাগজ বা নোট সীট খরচ করে, সুবিধামত যুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে, বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে (বিধি থাকলে) ঐ যে আমার অধঃস্তন সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীগণ আমার নিকট পেশ করতেন, আর আমি তা সই করে অনুমোদন করে দিতাম, সেটাই নোটিং। সেটাই আমার আইন। সুতরাং আইন থাকলেও তাতে কি হল? এই নোটিং এর মাধ্যমে আমি আমাদের সুবিধা মত আইন তৈরী করে দিতাম। এভাবেই আমি জনগণের সমস্যা সমাধান করতাম।
মিঃ নটঃ বুঝলাম, নোটিং করে সমস্যার সমাধান করতেন। কিন্তু, এতে তো পক্ষপাতহীন কিংবা সবার জন্যে সমান কোন ব্যবস্থা করা যেত কি?যেমন, আমরা বলি, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কেননা, যে যার মত, যুক্তি দেখিয়ে নোটিং পাশ করিয়ে নিতে পারে আপনাকে দিয়ে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, একজনকে বিদেশ ট্রেনিং এ পাঠালেন, আর একজনকে পাঠালেন না, অথচ সব দিকেই সেই যুক্তি দেখান হল। তাহলে হলে কি বিষয়টি পক্ষপাত  দুষ্ট হল না? বুঝলাম, ব্যুরোক্রেসির কাজ বিধি-বিধান তৈরী করা। তারা সেটাই করুক  সঠিকতা বজায় রেখে ও পক্ষপাতহীনভাবে। এটাইতো গনতন্ত্র, তাইনা? আইনের চোখে সব নাগরিক সমান। আর তাহলে তো সেই নোটিং এর প্রয়োজন পড়ে না (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)।

গুলশানঃ ঠিকই বলেছেন, মিঃ নট। আমি তো এসব বুঝি নাই, মন্ত্রী থাকা কালে। তাহলে, এখন বলেন আমাদের কি করতে হবে?
মিঃ নটঃ সিভিল সার্ভিসের ঐ সব মেধাবী অফিসারকে দিয়ে আপনার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে, মানুষের অধিকারকে মাথায় রেখে, গণ-শুনানী করে, ওয়েবসাইটে মতামত নিয়ে, কিছুটা সময় নিয়ে, অন্যান্য দেশের সাথে মিলিয়ে দেখে যুগোপযোগী বিধি-বিধান তৈরী করেন, যা দিয়ে সব কাজ চলবে, কোন ব্যত্যয় হবে না তার। সবাই ঐ এক বিধিতে চলবে। এতে কাজও সহজ হবে। নোট চালাচালিতে অযথা মূল্যবান কর্মঘন্টা নষ্ট হবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যাবে।

গুলশানঃ ঠিক আছে, আমি আমার দলের লোকজনকে তাই পরামর্শ দিব। এর মধ্যে মাহমুদুল পর পর দু’টো ছক্কা মেরেছে, আর গ্যালারীর মত ইমরুলের ড্রয়িং রুমে এসেছে তার উত্তাপ। (চলবে)

লেজুড়সমূহঃ তাৎক্ষণিক বার্তা, গণতন্ত্র চর্চা, মানুষের অধিকার, আইন ও অধিকারের চর্চা, নোটিং, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, গণ-শুনানী এবং এক বিধি।

[দায়িত্ব পরিত্যাগঃ প্রিয় পাঠক/সদস্য মনে রাখুন: এ লেখার চরিত্রগুলো কাল্পনিক। বাস্তবে এই চরিত্রগুলোর কোনও অস্তিত্ত্ব নেই। তাছাড়া, প্রধান চরিত্র মিঃ নট মূলত একটি শক্ত ও জটিল গ্রন্থির বিমূর্তকরণ মাত্র যার বিচরণক্ষেত্র তামাম দুনিয়াব্যাপী। তবে এই চরিত্রগুলোর আলাপচারিতায় বা তার বিশ্লেষণে যা বের হয়ে এসেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সত্য এবং তা বাস্তবতার নিরিখে পাঠকের সক্রিয় বিবেচনার দাবী রাখে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আবার চরিত্রগুলোর আলাপচারিতায় ও প্রতিটি ঘটনায় বা দৃশ্যে কো্ন না কো্ন একটি সমস্যার (ছোট কিংবা বড় যাই হোক) বর্ণনা, ব্যাপ্তি, বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্যক্ষেত্রে তার সমাধানের ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতে কারো কোনো দ্বিমত, ভিন্নমত, মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তা লেখককে ই-মেইলে বা ফেসবুকে অনুগ্রহপূর্বক অবহিত করতে পারেন। ই-মেইল ঠিকানাঃ khandkera0565@gmail.com । কেউ চাইলে ফেস বুক বা স্ক্যাইপেও লেখকের সাথে যুক্ত হতে পারেন। স্ক্যাইপ আই ডিঃ Khandker.ahmed898 । যেহেতু চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তাই বর্ণনা ও বিশ্লেষণ যাই হোক না কেন, তাতে কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের সংক্ষুব্ধ হবার কোনোই কারণ নেই। ব্যাখা-বিশ্লেষণগুলোকে তাই শুধুই জ্ঞান-চর্চা বা গবেষণামূলক বিষয় হিসেবে দেখার জন্য সম্মানিত পাঠকবৃন্দকে/সদস্যবৃন্দকে অনুরোধ করছি।ধন্যবাদ। খন্দকার হাবীব আহ্‌মেদ, নিউ ইয়র্ক।]

(লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত)