যে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, সেই মেরুদন্ড এখন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে নড়বড়ে হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে । দেশে শিক্ষা পদ্ধতি আর শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক বেশ জমজমাট। আমার বাল্যবন্ধু সুইডেন প্রবাসী রহমান মৃধা বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার উন্নয়ন নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করে চলেছেন। প্রবাসী হলেও তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার মান ও সার্বিক নড়বড়ে অবস্থা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ তাঁর মতে সুশিক্ষা অর্জিত না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনই আসতে পারে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষা থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের প্রসঙ্গ এক কঠিন বাস্তবতায় পরিনত হয়েছে। এই ব্যাধি ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। এখন এই ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা শুরু হয়েছে। কিন্তু উপায় যে আর মেলে না। আমার সুইডেন প্রবাসী বন্ধু রহমান মৃধা গোটা শিক্ষা পদ্ধতির গলদ খুঁজে বের করে এর স্থায়ী প্রতিকারের জন্য সরকার ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান রেখেছেন। তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি দেশে একটি বা একাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষকদের মধ্যে বুনিয়াদী, কার্যকর ও আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার এক নতুন চিন্তা সরকার ও দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন।এই লক্ষ্যে একত্রে কাজ করার জন্য তিনি সরকার ও জনগণকে অনুরোধ করেছেন। সেখানে যেন আধুনিক, বিজ্ঞান মনস্ক এক অগ্রণী চিন্তায় আমার পৃথিবী উদ্ভাসিত হয় আমার জ্ঞানের আলোকে। এই শিক্ষা হবে আমাদের উপার্জনের হাতিয়ার। রহমান মৃধার কথায়, শিক্ষা গ্রহনের পরেই প্রতিটি মানুষের সব ব্যস্ততা আবর্তিত হয় প্রত্যাশিত একটি চাকরীকে ঘিরে। এক্ষেত্রে দেশে এমন অবস্থা বিরাজ করছে যেখানে উচ্চ শিক্ষিত হতে যত বছর সময় লাগছে, চাকরি পেতে সেই ছাত্রকে এর চেয়েও বেশি সময় অপচয় করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তিনি একাধিক আধুনিক ধারনা দিয়েছেন। তার মতে, বর্তমান বিশ্বে চলছে চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং গোটা বিশ্বের শিল্পকারখানা, প্রযুক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এখন আজীবন চাকরি বলে কিছু নেই, চাকরি আছে ততদিন যতদিন কাজ আছে এবং কাজ আছে ততদিন যতদিন চাহিদা আছে। শিক্ষা ও শিক্ষার মান নির্ভর করছে গ্লোবাল চাহিদার উপর এবং তাও হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লেভেলে। সেক্ষেত্রে নিশ্চিত করে বলা কঠিন কী পড়লে সারা জীবন চাকরির গ্যারান্টি মিলবে। তবে সারা জীবন টেকসই ইন্ডাস্ট্রি প্রভাইডার এবং যোগ্য নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে হলে দরকার সময়োপযোগী সুশিক্ষা।

বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উর্দ্ধমুখী এক দেশ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও সময়ের স্রোতে এ দেশের সব সেক্টরেই লেগেছে আজ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। কিন্তু আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে এ ছোঁয়া আজও লাগেনি! চাহিদা বলছে কী পড়তে হবে এবং কেন পড়তে হবে। এ সময়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে এবং প্রত্যেকটি শিক্ষককে জানতে হবে চাহিদাগুলো কী এবং তার জন্য কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রনালয় এবং সকল শ্রেনীর শিক্ষকদের সুশিক্ষা গ্রহন- প্রদানের আওতায় আনতে হবে এবং তা বাস্তবয়ন করতে হলে বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প নেই। শিশুদের ১-১৫ বছর বয়সের মধ্যের সময়টা খুবই গুরুত্বপুর্ন। তাদেরকে মানবতার ফর্মে আনতে হলে তাদেরকে মানসম্পন্ন পরিবেশের মধ্যে শিক্ষা দান করে গড়ে তুলতে হবে এবং একই সাথে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে পর্যায়ক্রমে গড়ে তুলতে হবে সুশিক্ষার সার্বিক অবকাঠামো যেখানে থাকতে হবে জানার থেকে শেখা। কোন প্রকার দুর্নীতি বা অনিয়ম যেন কলুষিত করতে না পারে শিক্ষা প্রশাসনকে, শিক্ষাঙ্গণকে। একই সাথে গণতন্ত্রমনা ও সৃজনশীল নাগরিক হিসাবে নিরাপদে ও গর্বের সাথে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করবে সবাই এবং মতামতের ভিন্নতা সত্ত্বেও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তারা সামাজিক ঐক্য সৃস্টি করতে সক্ষম হবে।

শিশু বিদ্যালয় শিশুদের জন্য অনুকরণ এবং অনুসরণের জায়গা, সেজন্য এই সব শিক্ষাঙ্গনে থাকা চাই শিশু মনোবৈজ্ঞানিক, সমাজকর্মী।সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদির সাহায্যে বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টিভগ্নির আলোকে শিক্ষা দান ও প্রশিক্ষন প্রদান চলবে, যেখানে মননশীলতা চর্চা ও বৈশ্বিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে শিশুদের প্রারম্ভিক জীবন।

এই ব্যপারে তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছেন-

আছে কি বাংলাদেশের শিশু বিদ্যালয়ে এমন কোন শিক্ষক বা শিক্ষা পদ্ধতি চালু, যেখানে চর্চা হচ্ছে এমন মানসম্মত শিক্ষা ? বা সেই ভাবে তৈরি হচ্ছেন কি তেমন শিক্ষক যিনি পারবেন মোকাবেলা করতে ভবিষ্যতের এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার একমাত্র বাহক শিক্ষক সমাজই যদি মজবুত না হয়, শিক্ষার্থী নামক নতুন দিনের অভিযাত্রীরা কি নির্বিঘ্নে শিক্ষা নামক বৈতরণী পাড়ি দিতে পারবেন? বর্তমান শিক্ষা গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ, সনদপত্রসর্বস্ব, তত্ত্বীয় বিদ্যাপ্রধান, অপর্যাপ্ত ব্যবহারিক শিক্ষা, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল এবং পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসারী, তাই আশানুরূপ ফল লাভ হচ্ছে না।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়েরও কোন ব্যবস্থা নেই। আবার শিশু বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্যও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা নেই। ফলে দেশে দিনে দিনে শিক্ষিতের হার বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার মান। তাই দেশের জনশক্তিকে দ্রুত জন সম্পদে রুপান্তর করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। দুঃখের বিষয় নাম সর্বস্ব ও দায়সারাগোছের শিক্ষা ম্যানেজমেন্ট এর কারনেই আজ শিক্ষার এই অধ:পতন হয়েছে। বর্তমান যে সব বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা জানে না কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া দরকার একজন শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। পুরো শিক্ষাঙ্গন খুঁজলে পাওয়া যাবে খুব কম সংখ্যক দরকারী গুণসম্পন্ন শিক্ষক, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক । শিক্ষামন্ত্রনালয়ের রদবদল করতে হবে প্রথমে এবং জনগনের মনোনীত প্রার্থী ও স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে এ কাজ শুরু করতে হবে।

দেশে লাখ লাখ বেকার তৈরির এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কি কোনো জবাবদিহিতা আছে? সরকারের কী বক্তব্য এই ব্যপারে? সচেতন জাতি খুঁজে বের করে সমাধান,অজুহাত নয়। সাবধানতাই একমাত্র সুশিক্ষার পথ। সুশিক্ষার মান সম্পন্ন কারিগর পেতে হলে এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হলে দরকার এই বিশেষাযিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টের মধ্যে জানতে হবে, জানতে হলে শিখতে হব, শিখতে হলে পড়তে হবে, আর পড়তে হলে চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষকদের। তবেই হবে শিক্ষার স্বার্থকতা আর শিক্ষক হবে সুশিক্ষার কারিগর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেকার তৈরির কারখানা হবে না।বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে তার সমাধান।তাই শিক্ষাঙ্গনে এক বিরাট পরিবর্তনের জন্য চাই সংশ্লিষ্ট সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ এমনটাই মনে করেন সুইডেন প্রবাসী রহমান মৃধা। আমিও তার চিন্তাধারার সাথে এক মত।

রতন ভট্টাচার্য,
সহকারী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, কে,এইচ ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী।