আমার একমাত্র মেয়ে নুসরাত। সেদিন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সে। আর ওই সময়ই তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমার ভেতরে কী চলছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। মেয়ে হারানোর বেদনায় কলিজায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে এভাবেই কথাগুলো বলে অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরাতের বাবা কে এম মুসা।

নুসরাতের বাবা বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবাই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের কারণে আমার মেয়ের এই পরিণতির কথা সবাই জানতে পেরেছে। এই কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন কে এম মুসা।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১১টা। ঠিক দেড় ঘণ্টা আগে (সাড়ে ৯টা) মারা গেছেন নুসরাত জাহান। একমাত্র মেয়ের মুৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর অচেতন মা শিরিন। বার্ন ইউনিটের দুইতলা থেকে স্ট্রেচারে করে শিরিনকে নেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। বাবা মুসা তখনো বার্ন ইউনিটের দুইতলায়। অনেকেই তাঁকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। মুসা শুধু বলছিলেন, আমার মেয়ের জীবন ওরা কেড়ে নিল।

মেয়ে নুসরাতের জন্য দোয়া চাইছিলেন তিনি। তখন নুসরাতের খালাতো বোন ফরিদা বলছিলেন, আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা নুসরাতের ভাই রায়হান হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ছেলের কান্না দেখে বাবা মুসাও কাঁদতে থাকেন। আর বলছিলেন, আমি বিচার চাই। ন্যায়বিচার চাই।

মুসা তখন বার্ন ইউনিটের লিফট দিয়ে নিচে নামছিলেন। লিফটের ভেতরে মেয়ের নাম বলে কেঁদে ওঠেন। বলেন, আমি সুবিচার চাই। আইনে যে শাস্তি আছে, সেই শাস্তি চাই। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নুসরাতের খালাতো বোন ফরিদা বলে ওঠেন, চাওয়া পাওয়া একটাই, সিরাজ উদ দৌলার ফাঁসি চাই। আর কিছু চাই না।

নুসরাতের বাবা কে এম মুসা আরো বলেন, সেই দিন আমার মেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু সেই দিনই আমার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটেছে। আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কী বলব জানি না। আমাদের ভেতরে যে কী চলছে, তা আমি বোঝাতে পারছি না। আমার কলিজায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

দোষীদের বিচার দাবি করে নুসরাতের বাবা বলেন, এরই মধ্যে আমার মেয়ের বিষয়ে সবকিছুই প্রকাশিত হয়েছে। আমার দাবি, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেন সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার হয়।

পোড়া শরীর নিয়ে টানা পাঁচদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গতকাল বুধবার রাতে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন নুসরাত। আজ ময়নাতদন্তের পর তাঁর মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

নুুসরাত এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এ কে এম মুসা মানিকের মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। গত ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে দুর্বৃত্তরা তাঁর গায়ে আগুন দেয়। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।

পরিবারের অভিযোগ, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নসিরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে।

এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের লোকজন। কিন্তু নুসরাত অপারগতা প্রকাশ করেন।

নুসরাতকে গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে অধ্যক্ষসহ কয়েকজনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

নির্বাক মা শিরিন আক্তার। নিথর হয়ে পড়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো তাঁর নয়নের মণি নুসরাত জাহান রাফিকে। বাবা মাওলানা এ কে এম মুসা কিছুক্ষণ পরপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠছিলেন। বলছিলেন, ‘আহা! আমার মেয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। ওরা আমার মেয়েকে আগুন দিয়ে পুড়ি মারল। ছোট ভাই রায়হানের বুকফাটা কান্না। মুখে কোনো কথা নেই তাঁর। এমন দৃশ্য বুধবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করেন নুসরাতের মা। ছাত্রীর স্বজনদের অভিযোগ, মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় অধ্যক্ষের পক্ষের লোকজন নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। নুসরাতের পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, সেদিন পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।। গত শনিবার গুরুতর আহত অবস্থায় ওই মাদ্রাসাছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

এর আগে নুসরাতকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তাঁর শরীরের ৭৫ শতাংশ আগুনে পুড়ে যায় বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। নুসরাতের ফুসফুসকে সক্রিয় করতে গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে অস্ত্রোপচার করা হয়।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, মুত্যুর কারণ রক্ত ও ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণ থেকে কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেইলিয়র (হৃদ্যন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ) হয়। এতেই মুত্যু হয় তাঁর।