1দৈনিক বার্তাঃ স্থানীয় সরকার খাত প্রকল্পের  মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ ঘুষের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে আলোর মুখ  দেখে না অনেক প্রকল্প। এছাড়া প্রকল্প প্রণয়নের  ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনৈতিক  নেতাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ তো রয়েছেই।

রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে টিআইবি  ‘স্থানীয় সরকার খাত: সুশাসনের  চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক  গোলটেবিল আলোচনা এবং টিআইবি পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।

প্রতিবেদন  তৈরি করেন টিআইবির গবেষক মো. রবিউল ইসলাম, নাহিদ শারমীন ও ফারহানা রহমান। অনুষ্ঠানে রবিউল ও ফারহানা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। উপস্থাপন  শেষে গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর  গোলটেবিল আলোচনা হয় । এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। এছাড়া আরো বক্তব্য  দেন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ জারিনা রহমান খান, সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান,ড.তোফায়েল আহমেদ,টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ। সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডেও সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের কারণে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি হয় না। ফলে স্থানীয় উন্নয়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় না ও টেকসই হয় না।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি ও বরাদ্দ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য  থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয় না। রাজনৈতিক প্রভাব ও সুশাসনের দুর্বলতার কারণে স্থানীয় সরকার খাতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প ও বিশেষ বরাদ্দ পাওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে ঘুষ দিতে হয় প্রকল্প ভেদে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কার্যাদেশ মূল্যের ৫ শতাংশ  থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

গবেষণায় উঠে আসে, কাজের জন্য ঠিকাদারদের ঘুষ দিতে হয়। ইউপিপিআরএ-এর বরাদ্দ আসার পর মেয়র, নির্বাহী প্রকৌশলী ও টাউন ম্যানেজারের  যোগসাজশে কেটে রাখা হয় ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। টিআর ও কাবিখার বরাদ্দ ও বিলের টাকা ছাড়া করাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে (পিআইও) ঘুষ দিতে হয় টন প্রতি এক হাজার  থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া উন্নয়নমূলক কাজে কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের ঘুষ দিতে হয় ১০ শতাংশ  থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। আর সমঝোতার মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজ বণ্টনে কমিশন দিতে হয় ১০ শতাংশ  থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। এরকমভাবে বিভিন্ন  ক্ষেত্রে ঘুষ ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে।

সেবামূলক কার্যক্রমেও (সনদ সংগ্রহ,  ট্রেড লাইসেন্স,বিচার সালিস) এভাবে বিভিন্ন হারে ঘুষ দিতে হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে তৃণমূল পরযায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা বন্ধ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় পরিষদ কাজ করবে। এছাড়া প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের সুষম বণ্টনসহ ১৮টি সুপারিশ উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া স্থানীয় সরকার খাতে দুর্নীতির হার তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প ও বিশেষ বরাদ্দ বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগে ঘুষ দেওয়া হয় প্রকল্প ভেদে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।পৌরসভার মেয়রের সম্মানী বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে ঘুষ দেওয়া হয় ২০ লাখ টাকা,  পৌরসভার পক্ষ থেকে নিরীক্ষা কর্মকর্তাকে (সিএজি) ঘুষ  দেওয়া হয় ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষ  দেওয়া হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। এছাড়া সমঝোতার মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজ বণ্টনে কমিশন বরাদ্দের ১০  থেকে ১৫ শতাংশ, কার্যাদেশ বিক্রিতে কমিশন কার্যাদেশ প্রাপ্তি মূল্য এবং দরপত্র মূল্যের ১০  থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।

ড.তোফায়েল আহমেদ বলেন, একটি প্রকল্পে মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ চলে যায় ঘুষে। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে স্থানীয় সরকার খাতের অনেক প্রকল্প আলোর মুখ দেখে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেক প্রকল্প পরিকল্পনা অনুমোদন হওয়ার পরও ক্ষমতাধররা তাদের নির্বাচনী এলাকায় কাজের জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে, ফলে অনুমোদিত প্রকল্প পরিকল্পনায় পরিবর্তন করতে হয় এবং প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধি দ্ধ হয়।হাফিজউদ্দিন খান বলেন, অনিয়ম দুর্নীতির পাশাপাশি নানামুখী সংকট রয়েছে সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগগুলোতে। স্থানীয় সরকার খাতে জনবলের স্বল্পতা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়োগ-পদায়ন বদলিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি, সম্মানী ও বেতন ভাতা সংক্রান্ত অনিয়ম দুর্নীতি রয়েছে।