image_147345.amnestylogo

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৪ নভেম্বর: বাংলাদেশে অব্যাহত মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হচ্ছে বলে আশঙ্কা করে একে গভীর উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷মৃতু্যদণ্ড বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ফাঁসির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপেরআহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি৷সোমবার সুপ্রিমকোর্ট জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখার প্রেক্ষাপটে অ্যামনেস্টি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই আহ্বান জানিয়েছে৷

অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বলেন, বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অব্যাহতভাবে আরোপ করা গভীর উদ্বেগজনক৷ গত মৃতু্যদণ্ডাদেশ ঘোষণার নয় মাস বিরতির পর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তিনটি ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হলো৷ অ্যামনেস্টি বলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই মৃতু্যদণ্ডাদেশ বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ফাঁসির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্ত ক্ষেপ হবে না৷

আব্বাস ফয়েজ বলেন, ফাঁসি স্বাধীনতা যুদ্ধের শিকার লাখ লাখ লোকের জন্য ন্যায়বিচার বয়ে আনার বদলে কেবল সহিংসতার স্থায়ী চক্রই সৃষ্টি করবে৷ অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২ নভেম্বর আরেক জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ এর আগে ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকেও মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হয়৷ ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইসিটি যে ১২টি আদেশ দিয়েছে, তার সবই বিরোধী দলের সদস্যদের (প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্তদের) বিরুদ্ধে৷ এগুলোর মধ্যে ৯টি মৃতু্যদণ্ডাদেশ৷

অ্যামনেস্টি জানায়, সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করতে পারে৷ কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় রিভিউ আবেদন করার অধিকার দৃশ্যত থাকছে না৷অ্যামনেস্টি জানায়, এখন পর্যন্ত ১৪০টি দেশ মৃতু্যদণ্ড আইনগতভাবে বা প্রথা হিসেবে বাতিল করেছে৷ যে মাত্র নয়টি দেশ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ফাঁসি কার্যকর করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ অ্যামনেস্টি সবক্ষেত্রে মৃতু্যদণ্ডের বিরুদ্ধে৷সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের দেওয়া সাজা বহাল রাখায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হবে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ রায়ের মধ্য দিয়ে এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো৷

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ রায় দেন৷কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন৷ গত বছরের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২ তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেন৷ ট্রাইবু্যনালে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সাতটির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ (১, ২, ৩, ৪ ও ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়৷ ট্রাইবু্যনালের দেওয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান৷ তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি৷ চলতি বছরের ৫ জুন থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়৷ ১৬তম দিনে ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়৷ ওই দিন আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন৷ এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় সোমবার কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় ঘোষণা করা হলো৷ এটি আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় রায়৷

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ২০১১ সালের ২৪ জুন থেকে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান৷জাহাঙ্গীর কবির জানান, ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কামারুজ্জামান ছাড়াও জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামসহ এ করাগারে মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত ১০৪ জন, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ৪৪১ জনসহ দুই হাজারের মতো বন্দি রয়েছেন৷

রিভিউ করবেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী: জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল বিভাগের দেয়া মৃতু্যদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের নোটিশ পাঠানো হয়েছে৷ সোমবার কামারুজ্জামানের আপিলের রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টেও সংশ্লিষ্ট শাখায় নোটিশটি পাঠানো হয়৷ মামলায় অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদিন এ নোটিশ পাঠান৷

রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইবু্যনাল তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন৷ ২ জুলাই এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়৷পাঁচ অভিযোগ: ট্রাইবু্যনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনা হয়৷ এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ (১, ২, ৩, ৪ ও ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়৷ এই পাঁচটিতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান৷

তৃতীয় অভিযোগ ( সোহাগপুরে নির্বিচারে হত্যা): একাত্তরের ২৫ জুলাই সকালে আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে৷ ওই হত্যাযজ্ঞের পর থেকে গ্রামটি বিধবাপল্লী নামে পরিচিত হয়৷আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২০(২) ধারা অনুসারে তৃতীয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস)আইন,১৯৭৩-এর ২০(২) ধারায় চতুর্থ অভিযোগেও কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইবু্যনাল৷ তবে আপিল বিভাগ এই অভিযোগে তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে মৃতু্যদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন৷আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল৷

এর আগে তার দলেরই আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তির পর ২০১৩ সালের ১৭সেপ্টেম্বর যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷ এরপর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর তার মৃতু্যদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়৷আর চলতি বছর ১৭সেপ্টেম্বর আপিলের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা মৃতু্যদণ্ড থেকে কমিয়ে আমৃতু্য কারাদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়৷

ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল৷ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেপ্তারের পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ট্রাইবু্যনালের প্রসিকিউশন ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইবু্যনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে৷ ৩১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়৷ পরে মামলাটি ট্রাইবু্যনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়৷ওই বছর ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়৷