123

দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ১৬ নবেম্বর: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে চারটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্তে নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা, রাবির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সূত্র ধরে হত্যা ক্লু খোঁজা হচ্ছে৷

এ সূত্র ধরে রোববার দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন আহম্মেদসহ মোট ২০ জনকে আটক করেছে পুলিশ৷রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বাংলামেইলকে জানান, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দা পুলিশসহ বেশ কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে৷ ৪টি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্তে নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷ চারটি কারণের মধ্যে পারিবারিক ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে৷

পুলিশ কমিশনার ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান আরো জানান, শনিবার ফেসবুকে ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ -২ এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ ফেসবুকের ওই পোস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পুলিশের উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি টিম কাজ করছে৷ খুব শিগগিরই ওই পোস্ট কারা এবং কোথা থেকে করেছে সে রহস্য বের করা সম্ভব হবে৷

পুলিশ কমিশনার বলেন, শিক্ষক শফিউল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি৷ নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলাটি করা হবে৷ নিহতের দাফন শেষে মামলা করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছে৷রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) কেএম নাহিদুল ইসলাম জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নগরীর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন আহম্মেদসহ ২০ জনকে আটক করা হয়েছে৷ এছাড়াও পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে৷

আটককৃতদের রাজশাহী মহানগর গোয়ান্দা পুলিশের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷উল্লেখ্য, শনিবার বিকেলে সাড়ে ৩টায় রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানার বিহাস এলাকায় দুবর্ৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে রাবির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. একেএম শফিউল ইসলামকে৷ এদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গি গোষ্ঠীতে দায়ী করেছেন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে৷ রোববার গাইবান্ধায় পারিবারিক কবরস্থানে বাবাকে দাফনের পর সৌমিন সাহরিদ জাভিন বলেন, আমার বাবার হত্যাকাণ্ডে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলো জড়িত৷ আমি আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র সৌমিনের এই বক্তব্যের আগে ফেইসবুকের একটি পাতায় অধ্যাপক শফিউলকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়৷শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় লালনভক্ত অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলন খুন হওয়ার পাঁচ ঘন্টা পর আনসার আল ইসলাম বাংলদেশ-২ নামে ওই ফেইসবুক পাতাটি খোলা হয়৷

এতে বলা হয়েছে, উই আর দি হেল্পারস অব শরিয়া ইন বাংলাদেশ৷ উই আর মুজাহিদিন সাবিলিল্লাহ৷ওই পোস্টে কালো পশ্চাত্‍পটে শফিউল ইসলামের ছবি দিয়ে তার ওপর লাল রঙে আড়াআড়ি ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে৷ছবির নিচে লেখা হয়েছে- ‘এ কে এম শফিউল ইসলাম (ফাইল ক্লোজড)/ অপরাধ এপ্রিল ২০১০/ শাস্তি প্রদান নভেম্বর ২০১৪’৷আনসার আল ইসলাম নামে বাংলাদেশে কোনো সংগঠনের কার্যক্রম আছে কি না- সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ৷

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা থাকতেও পারে৷ পুলিশ সব বিষয়ই খতিয়ে দেখছে৷শফিউল হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে রোববার বিকাল পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করেছে রাজশাহী পুলিশ৷ এর মধ্যে একজন কলেজ অধ্যক্ষও রয়েছেন৷

ক্যাম্পাস সংলগ্ন যে এলাকায় শফিউলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, ওই এলাকার কাছেই এক দশক আগে আরেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. ইউনুসকে একইভাবে হত্যা করা হয়৷ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ে দুই জঙ্গির মৃতু্যদণ্ড হয়েছে৷সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউলকে রোববার জোহরের নামাজের পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শালমারা ইউনিয়নের হিয়াদপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়৷রাজশাহী থেকে রোববার ভোরে অধ্যাপক শফিউলের মরদেহ তার গ্রামের বাড়িতে আনা হয়৷ লাশ দেখতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিল৷

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষসহ চারজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ৷ এ নিয়ে এ ঘটনায় মোট ছয়জনকে আটক করা হলো৷আটকদের মধ্যে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন আহমেদের নাম জানা গেলেও বাকিদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি৷

মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন,রোববার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বিনোদপুর থেকে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুনকে আটক করে৷ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের শক্ত অবস্থান রয়েছে ইসলামিয়া কলেজে৷

অধ্যাপক শফিউলকে হত্যায় কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা আছে কি না তদন্তে সে বিষয়টিও গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন বলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন৷দুপুরে সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গোয়েন্দারা বিভিন্ন মোটিভ নিয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছে৷ এটা পলিটিক্যাল হতে পারে আবার জঙ্গিদের কাজও হতে পারে৷ কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট করে এখনই বলা যাবে না৷ ইসলামিয়ার অধ্যক্ষ হুমায়ুনকে আটকের অভিযানে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরো তিনজনকে ধরা হয়েছে বলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আব্দুল মজিদ জানিয়েছেন৷

তিনি ক বলেন, অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে হত্যায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে৷ শনিবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চৌদ্দপাইয়ে নিজের বাসায় ফেরার পথে বিহাস পল্লীতে হামলার শিকার হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলাম (৪৮), যিনি বাউল সাধক লালনের ভক্ত ছিলেন৷মাথা, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখমসহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতির মধ্যেই মারা যান তিনি৷হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করে র্যাব৷

ওসি আলমগীর বলেন, অধ্যাপক শফিউলের ওপর হামলায় দুইজন অংশ নিয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন৷শনিবার ওই হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা বিহাস পল্লীর আশপাশে অভিযান চালিয়ে দুই জনকে আটক করে পুলিশ৷সহকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে রোববার সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে পদযাত্রা ও শোক সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা৷সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তারা৷

অধ্যাপক শফিউলকে হত্যা শুধু একজন ব্যক্তি নয়,প্রতিষ্ঠানকে হত্যা মন্তব্য করে মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো.শাহ আজম সমাবেশে বলেন,আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একদিকে শোকাহত অন্যদিকে শঙ্কিত৷ যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে তাদের যদি এভাবে হত্যা করা হয় তাহলে সেটা কোনো ব্যক্তি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে হত্যা করা হয়৷গত এক দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে খুন হলেন শফিউল ইসলাম৷

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহেরকে তার ক্যাম্পাসের বাসায় হত্যা করে লাশ বাসার পাশের ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল৷তার আগে ২০০৪ সালে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর গ্রামে খুন হয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ইউনূস আলী৷ তাকে হত্যার দায়ে দুই জঙ্গির মৃতু্যদণ্ড হয়৷