দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ ডিসেম্বর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার দেশে চমত্কার পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যত্ গড়ে তুলতে চায়৷তিনি বলেন, ‘সংঘাত নয়, আমরা শানত্মি চাই৷ সকলের প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা দেশে একটি সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে চাই৷ আমাদের লক্ষ্য বাঙালি জাতির জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা যাতে বিশ্বে আমরা একটি মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান লাভ করি৷সোমবার বিকেলে রাজধানীতে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে জাতীয় পর্যায়ে শিল্পাচার্য্য জয়নুল আবেদদিনের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন৷
শেখ হাসিনা বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে৷ অন্যদিকে সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে তাদের ধমর্ীয় উত্সব পালন করে আসছে৷ এটি একটি ঐক্যবদ্ধ আস্থার প্রমাণ৷ বাঙালি জাতি এটি সম্ভব করে তুলেছে এবং বিশ্বে দৃষ্টানত্ম স্থাপন করেছে৷বছরব্যাপী শিল্পাচার্যের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে৷ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পী মোসত্মফা মনোয়ার এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সহধর্মিনী জাহানারা আবেদিনও বক্তৃতা করেন৷
এতে জয়নুল আবেদিন স্মারক বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর৷ স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস৷প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে৷ ধর্মের লেবাসধারীরা ধমর্ীয় উপসানালয়ে হামলা করছে৷ আমরা গত বছর দেখেছি, কীভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের চত্বরে পবিত্র কোরআন শরীফে আগুন দেয়া হয়৷ জাতীয় মসজিদ তছনছ করা হয়৷
তিনি বলেন, একমাত্র আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যই পারে মানুষের এসব অমানবিক আচরণের পরিবর্তন আনতে৷ আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবীদের এ ব্যাপারে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে৷ মানুষের মননে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট হচেছ অসাম্প্রদায়িকতা৷ ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে মানুষে মানুষে মিলন হবে- এটাই বাঙালি সংস্কৃতির মূল কথা৷ আজকে মাঝে মধ্যে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে, বাঙালি জাতি কি তার সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচু্যত হচেছ ৷
শিল্পাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে শিল্প ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতি সত্বা বিকাশে তার অবদান জাতি চিরদিন গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে৷একই সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনিও শিল্পী ছিলেন৷ তবে তাঁর ৰেত্র রঙ-তুলির জগতে ছিল না৷ তিনি ছিলেন রাজনীতির নান্দনিক শিল্পী৷ বাঙালির মানসে তিনি শুধু স্বাধীনতার বীজমন্ত্র এঁকে দিয়েই ৰানত্ম হননি, তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন৷
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিল্পাচার্যের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ তাঁরা মননে-আদর্শে একই ধরনের মত ও পথের অনুসারী ছিলেন৷ এই দুই বাঙালি মহাপুরম্নষ বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে আজীবন কাজ করেছেন৷প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা শিল্পাচার্যকে বাংলাদেশের সংবিধানের স্কেচ করার দায়িত্ব দেন৷ তিনি সূচারম্নভাবে সে দায়িত্ব পালন করেন৷ পরবতর্ীকালে বঙ্গবন্ধু সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারম্নশিল্প ফাউন্ডেশন স্থাপনের দায়িত্বও দেন শিল্পাচার্যকে৷
তিনি বলেন, সকল শিল্পকর্মই যে লোক ঐতিহ্যের ধারায় প্রবাহিত হয় তার বাসত্মব রূপায়ণই আজকের ঐতিহাসিক সোনারগাঁও-এর বাংলাদেশ লোক ও কারম্নশিল্প ফাউন্ডেশন৷শেখ হাসিনা বলেন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন সাধারণ আটপৌরে মানুষের শিল্পী৷ সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র, দুঃখবেদনা ছিল এই মহান শিল্পীর ছবির উপজীব্য৷ তিনি একাধারে ছিলেন নিঃসর্গ প্রেমিক, অন্যদিকে তার রঙ-তুলিতে ফুটে উঠেছে দ্রোহের ভাষা৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাকতালীয় হলেও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলামের জীবনের সঙ্গে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অনেক মিল খুঁজে পাই আমরা৷ দুজনেরই জন্ম গ্রামে৷ ছাত্রাবস্থার একটা সময় তাদের কেটেছে ময়মনসিংহে৷ আমাদের জাতীয় কবি এবং শিল্পাচার্য তত্কালীন পিজি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় একই বছর অর্থাত্ ১৯৭৬ সালে মারা যান৷ দুজনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমাহিত করা হয়৷তিনি বলেন, একজন শব্দের কারুকার্যের মাধ্যমে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন৷ অন্যজন রঙ-তুলির আচড়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বঞ্চনাকে তুলে ধরেছেন৷
শেখ হাসিনা বলেন, শিল্পাচার্যের ৪৩’র দুর্ভিৰের ছবিগুলো মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরার পাশাপাশি তত্কালীন ব্রিটিশ রাজের এদেশের মানুষের প্রতি চরম অবহেলা এবং মানুষের দুর্দশা লাঘবের ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল৷
তিনি বলেন,একইভাবে ১৯৭০ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মহাপ্রলয়ের পর বঙ্গবন্ধু যেমন ছুটে গিয়েছিলেন দুর্গত মানুষের পাশে, শিল্পী জয়নুল আবেদিনও সেদিন ঘরে বসে থাকতে পারেননি৷ তিনিও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে দুর্গত এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন৷ সেখান থেকে ফিরে শিল্পী আঁকলেন তার বিখ্যাত ছবি ‘মনপুরা-৭০’৷ ৩০ ফুট দীর্ঘ এই শিল্পকর্মে শিল্পী সাইক্লোনের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ়চিত্তের ইঙ্গিতও তুলে ধরেন৷প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবনাশ্রয়ী বাসত্মবানুগ শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কৃতিত্ব সর্বজনস্বীকৃত৷ সাধারণ মাটির মানুষের বিচিত্র জীবনের বিভিন্ন দিক এবং নিসর্গ, নবান্ন, দুর্ভিৰ, জলোচছ্বাস, যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জীবজন্তু ইত্যাদি অনায়াসে তার শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে৷
