নদী-ভাংগন
দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫:
 
নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অভ্যাহত থাকায় কুড়িগ্রাম, শেরপুর, গাইবান্দা নওগাঁ মুন্সিগঞ্জসহ বেশ কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে চরম দূদর্শায় দিন কাটাচ্ছে এইসব এলাকার মানুষ। মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। কিন্তু সরকার কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল।কুড়িগ্রাম: ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।সোমবার সকাল থেকে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে, পানিবন্দি মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। কিন্তু সরকার কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল। বন্যা পরিস্থিতি দেখতে মঙ্গলবার সকালে কুড়িগ্রাম আসছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম)। জানা গেছে, জেলার ৯টি উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের ৪শ৫টি চর-দ্বীপ চর এবং নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে আরো নতুন নতুন এলাকা।

রৌমারীর যাদুর চর ইউনিয়নে জিঞ্জিরাম নদীর তীব্র স্রোতে লালকুড়া রাবার ড্যাম রোডের প্রায় ৩০ মিটার ভেঙে গেছে। একই ইউনিয়নের ধনারচর গ্রামের বেড়ি বাঁধের ৮শ ফিট ভেঙে গেছে। এছাড়া লালকুড়া থেকে বকবান্ধা ব্যাপারীপাড়া সড়কে তিন কি.মি. রাস্তা ভেঙে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তিনদিনে ইউনিয়নে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। যাদুর চর ইউনিয়নের পাহাড়তলী, যাদুরচর,কোমরডাঙ্গি, ঝুনারচর, খেয়ারচর মৌজার ৫৩টি গ্রামের মধ্যে ৪৫টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কাজ ও চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যা কবলিত মানুুষরা। অনেকেই নিজের বাড়িতে মাচার উপর অবস্থান নিয়েছেন। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলায় ২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে ব্রহ্মপুত্রে ৪ সেন্টিমিটার, দুধকুমারে ৭ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, সোমবার বন্যার্তদের জন্য নতুন করে ৫০ মেট্রিক টন চাল ও তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ১০০ মে.টন চাল ও ৩ লাখ টাকা। জেলায় কম বেশি প্রায় ৫ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে আরো ত্রাণ বরাদ্দ চেয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে।তিনি আরো জানান, বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে মন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯ টায় চিলমারী উপজেলার ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন হ্যালিপ্যাডে অবতরণ করবেন। পরে তিনি নৌ-পথে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করবেন এবং বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন। তার সফর উপলক্ষে সোমবার দুপুরে চিলমারী উপজেলা পরিষদে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

শেরপুর (বগুড়া): চারদিক কেবলই নীরবরতা। এরই মাঝে চলে বাঙালি নদীর ভয়াল গর্জন। রাত যতই গভীর হয় গর্জনও বাড়তে থাকে। অথচ ঘুমে তখন চোখ বন্ধ হয়ে আসে মানুষের। গা-মাথা টলতে থাকে। সেই ঘুমের ঘরেই বুকের মধ্যে দরপর করে। এই বুঝি আবার সবকিছু গ্রাস করলো বাঙালি।এমনই ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এলাকার মানুষের। কয়েকদিনে বাঙালি নদীর গর্ভে ছয়টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। রাত ১০-১২টার মধ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে। ঘুমের মধ্যেই সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তাদের একজন হেলেনা সন্তানসহ পানিতে তলিয়ে যান। পরে তার বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে এসে সন্তানসহ তাকে উদ্ধার করে। এভাবে বাঁধ এলাকার প্রায় শতাধিক মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। সোমবার বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের সাহেববাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের সঙ্গে কথা হলে এমনই চিত্র ওঠে আসে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেউ বসতবাড়ির টিনের চালা ও ঘেরা নিয়ে এদিক ওদিক রাখার কাজ করছেন। কেউবা নতুন করে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করছেন। ঘরের এলোমেলো কাপড় চোপড়সহ অন্য আসবাবপত্র গোছানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। সবমিলে চোখে-মুখে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা বাঁধ এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মোজাম্মেল হক জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে এই বাঁধের পাশে বসবাস করছেন। তখন বাঁধ থেকে বাঙালি নদী প্রায় ২০০ফুটের অধিক দুরুত্বে অবস্থান করছিল। কিন্তু এখন আগের সেই অবস্থা নেই।সময়ের ব্যবধানে ভাঙতে ভাঙতে নদীর বাঁধের একটি বিরাট অংশ গ্রাস করে ফেলেছে। আমাদের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। অব্যাহত ভাঙনের কবলে যে কতবার বসতবাড়ি সরাতে হয়েছে তাও মনে নেই। হেলেনা বেগম জানান, বাঙালির ভাঙনের কারণে গেল বছর কয়েকবার ঘর সরিয়ে অন্যত্র তৈরি করেছেন। এবার মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তিনবার বসতভিটা ভাঙনের শিকার হয়েছে। জায়গা জমি না থাকায় বর্তমানে বাঁধের পাড়ে বাঙালি থেকে মাত্র দেড় ফুট দূরে একটি ঝুপড়ি ঘর খাড়া করেছেন। সেখানে স্বামী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো রকম গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। এসব ব্যক্তিরা জানান, বাঁধ এলাকায় বিনোদপুর, তালপট্টি, কাশিয়াবালা, চকসাধি, সাতারা, নামাপাড়া গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার বসবাস করছেন। তারা জানান, প্রতিদিনই বাঙালি নদীর পানি বাড়ছে। পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে একটি সময় বাঁধ পেরিয়ে পানি এসব গ্রামের ভেতর প্রবেশ করবে। এতে করে শতশত বিঘার ফসলি জমি নষ্ট হবে। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বেন বলে তারা জানান। এ অবস্থায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

সিরাজগঞ্জ: হাটে-বাজারে আর গ্রামে গ্রামে মানুষের জুতো শেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন কার্তিক চন্দ্র রবি দাস। এবারের বন্যায় ঘরে তার কোমর পানি। উঠোনে কোমর ছাড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার বিলচতল গ্রামের এই প্রৌঢ়কে প্রতিদিনই কোমর পানি ডিঙিয়ে যেতে হয় হাট-বাজারে। শুধু হাটে এলেই চলে না- জুতো শেলাইয়ের কাজ করতে গ্রামে গ্রামে না গেলে সংসার চলবে না। কিন্তু আশপাশের সব গ্রামেই তো পানি। এ অবস্থায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার পরিবারের। কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন, আর চইলবার পাইরত্যাছি না বাবা।তিন সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করছেন তিনি। আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা ওয়াপদার উপর জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে তাকে বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। একই অবস্থা বিলচতল গ্রামের শাহ আলী, আব্দুল লতিফ, শামচুল আলম, আল মাহমুদ, মাইজবাড়ী গ্রামের হাসেন আলী, শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবলু, মাইজবাড়ী গ্রামের কদবানু বেওয়া, দেলবার মণ্ডল, চর মাইজবাড়ী গ্রামের মোহাম্মদ আলীসহ ১৫ গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারের। এদের মধ্যে বাঁধের ওপর ও বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা হয়েছে মাত্র ১৮৯টি পরিবারের। বাকি পরিবারগুলো পানির মধ্যে অসহায় জীবনযাপন করছেন। স্থানীয়রা জানান, প্রথম দফায় আগস্টের মাঝামাঝিতে যমুনার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাড়িঘরে পানি উঠতে থাকে। আগস্টের শেষ দিকে পানি কমতে শুরু করলেও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবার পানি বাড়তে শুরু করে।

বাড়ি থেকে পানি নামার আগেই আবারও প্লাবিত হতে শুরু করে। এভাবে তিন সপ্তাহ ধরে এসব ১৫ গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় দুর্বিসহ দিন কাটাচ্ছে। এদিকে, কাজ না থাকায় শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যে দুই বেলা ঠিকমতো খাবার জুটছে না। আবার বাড়িঘরে পানি ওঠায় রান্না করতেও সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। পাশাপাশি নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানিরও অভাব দেখা দিয়েছে। গবাদি পশুগুলোকে কোনোমতে দু-এক মুঠো খড় দিয়ে বাঁধের ওপর বেঁধে রাখা হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ইয়াকুব আলী মণ্ডল জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে যারা রয়েছেন, তাদেরই শুধু ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা পানিবন্দি অবস্থায় বাড়িতে আছেন তাদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্যই আসছে না। মাইজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহীদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম ও মোখলেসুর রহমান জানান, এ ইউনিয়নের ভাটিমেওয়া খোলা, মল্লিকপাড়া, সুতানালা, শ্রীপুর, বদুয়ার পাড়া, মাইজবাড়ী, ঢেকুরিয়া, বিলচতল, চর মাইজবাড়ী, কুনকুনিয়া, ছালভরা, পাইকড়তলী, হাটগাছা, ভাঙ্গার ছেও ও পোড়াবাড়ী গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাড়িতে পানি উঠেছে। এছাড়া নদী ভাঙনের কবলে ভিটেমাটি হারিয়েছে ১৪০টি পরিবার। মাইজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের ে য়োরম্যান তালুকদার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারিভাবে বেশকিছু পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। তবে সেটা যথেষ্ট নয়। আমরা আরও সাহায্যের জন্য আবেদন করেছি।

ভোলা:ভোলায় গত কয়েক দিনের বৃষ্টি থামলেও থামেনি মেঘনার ভাঙন। বরং মেঘনা নদীর তীব্রতা আরো বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ভাঙছে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। গৃহহারা হচ্ছে বহু পরিবার। ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে এসব পরিবার এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নদী ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের গাফিলতিকেও দায়ী করছেন স্থানীয়রা। এদিকে, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ত্রাণ পাননি বলেও অভিযোগ করেছেন।রবিবার বিকেলে ভোলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মেঘনার পাড়ে সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানান, মেঘনা নদীর ভাঙনে মাত্র ২ সপ্তাহে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকা, ওই এলাকার সহ¯্রাধিক ঘর-বাড়ি, ৩টি মসজিদ, ৫টি মক্তব, ২টি বোট, পুলিশ ফাঁড়ি, ইসলামী মিশন, ৩শ’ একর ফসলি জমি, ২ শতাধিক দোকান এবং ১ জন মাঝিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেসে গেছে দুই শতাধিক পুকুর ও শতাধিক ঘেরের মাছ সহ অন্তত শতাধিক গবাদি পশু। এতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা।ইলিশা ইউনিয়নের কালুপুর গ্রামের বাসিন্দা হানিফ খলিফা (৭৫) বলেন, ‘আমি বিগত ৫০ বছরেও এমন ভাঙন দেখিনি। মেঘনার তীরেই আমার বাড়ি ছিল। ছিল এক কানি ৯ গন্ডা জমি। যেই জমির লগ্নি করা হতো বছরে ৮০ হাজার টাকা। সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত আমি ৫বার মেঘনা নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছি। এখন আর কিচ্ছু নাই। খালি জীবনটা আছে কোন রকমে।’

01dainikteknafnews-640x480

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে আজ নদী বেশি ভাঙছে। কারণ গত প্রায় দেড় মাস আগে যখন নদী ভাঙন শুরু হয় তখন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নির্দেশে পাউবো কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে ভাঙন রোধে কিছু দিন ইলিশা কালুপুর এলাকা দিয়ে মেঘনার পাড়ে জিইও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করে। তবে ১৫ দিন পর হঠাৎ করে পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ঠিকাদার সেখানে জিইও ব্যাগ ফেলা বন্ধ করে দেন। তখন থেকেই ভাঙনের তীব্রতা দেখা দেয়।’হানিফ খলিফা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা যদি মাঝ পথে জিইও ব্যাগ ফেলা বন্ধ না করে আরো কিছু জিইও ব্যাগ ফেলতো তাহলে হয়তো ভাঙন রোধ হতো।একই গ্রামের বাসিন্দা শামছুদ্দিন (৪৫) বলেন, ‘মেঘনার ভাঙন যেন থামছেই না। মেঘনা নদীর ভাঙনে আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমার বাড়িঘরসহ সব তো নদীগর্ভে বিলীন হইছেই। এ ছাড়া ২৭ জেলেকে আমি নগদ ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা দাদন দিয়েছিলাম। সেই সব জেলেদের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা এখন লাপাত্তা। ওই টাকা আর পাওয়া যাবে কিনা-তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

শামসুদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদেরকে সরকারিভাবে কোন ত্রাণ বা সাহায্য দেয়া হয়নি।’ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে কোন ত্রাণ দেয়া হয়নি। অথচ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তাদেরকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। মোঃ আলাউদ্দিন (৭৪) নামে অপর একজন বলেন, ‘গত প্রায় দেড় মাসে নদী ভাঙনে বহু মানুষ গৃহহারা হলেও গত ২ দিন ধরে নদীর ¯্রােত কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তাই ভাঙন রোধে এখনই নদীর তীরে জিইও ব্যাগ এবং ব্লক ফেলার দাবি জানান তিনি। ইলিশা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হযরত আলী চৌকিদার (৫৫) বলেন, গত ২০ বছর যাবত এই খানে বসবাস করছি। কিন্তু বিগত বছরে এমন ভাঙন দেখিনি। নদী ভাঙনের কারণে তাকে এ পর্যন্ত ২/৩ বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সঠিকভাবে নদী ভাঙন রোধে কাজ করছেন না। তারা কোন রকম দায় এড়ানোর কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, গত ৩ দিনে কমপক্ষে ২ কিলোমিটার এলাকা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি এই নদীর গর্ভে ২টি বোট এবং জাহাঙ্গীর (৩৬) নামের একজন মাঝি হারিয়ে গেছে। ওই ২টি বোট এবং মাঝিকে এখনও খুজে পাওয়া যায়নি। বোট আর মাঝি সম্পর্কে তিনি বলেন, নদীর মাঝ খান দিয়ে ২টি বোট যাচ্ছিল; তখন হঠাৎ বোট দুটি নদীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আর জাহাঙ্গীর নামের মাঝি নদীর কিনারে নৌকায় বসে মাছ ধরার জাল কাটছিলেন, এমন সময় উপর থেকে বড় একটি মাটির স্তুপ তার উপর পরে। তখন সে নদীতে তলিয়ে যায়। তবে নদী ভাঙনের শিকার শর্বসান্ত এলাকায় যৎ সামান্য সাহায্য দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হেকিম বলেন, ‘মেঘনার ভাঙন থামেনি। বরং ভাঙনের তীব্রতা আরো বেড়েছে।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ভাঙন রোধে পাউবো ও ঠিকাদার অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এখনও মেঘনার তীরে টিউব ফেলা হচ্ছে।’ এ পর্যন্ত ৪১টি টিউব ফেলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।মাতামুহুরী নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে ছোট হয়ে আসছে লামা পৌর শহর

লামা :মাতামুহুরী নদীর অব্যাহত তীব্র ভাঙ্গনে বান্দরবানের লামা পৌর শহরসহ সদর, রুপসীপাড়া ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছার বিস্তৃর্ন এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকশ ঘরবাড়ি, কবরস্থান, শশ্মান, সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও শত শত একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানেও পৌর এলাকার শত কোটি টাকার স্থাপনা ও ফসলি জমি নদী ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে। অব্যাহত ভাঙ্গনের সাথে প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় লামা পৌর এলাকার নিম্মাঞ্চল প্ল-াবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বিগত দিনে ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধরণ ও লামা পৌরসভার পক্ষে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গন রোধ, বন্যার কবল থেকে লামা শহর রক্ষার জন্য একাধিকবার প্রকল্প গ্রহন করে প্রাক্কলন তৈরী করা হয়। সংশ্লিষ্টদের সাথে লবিং না থাকায় এর কোনটি অদ্যাবদি বাস্তবায়িত হয়নি। এতে করে প্রতি বছর বন্যায় ক্ষতির পরিমান বেড়েই চলেছে। নদী ভাঙ্গন ও বন্যার ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষার জন্য নদী সংরক্ষন প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী। জানা গেছে, লামা শহরটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার গুরুত্ব বিবেচনায় বান্দরবান জেলা সদরের পরেই এর স্থান। প্রতি বছর বর্ষা মৌসমে খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীর করাল গ্রাসে দু’কুল ভেঙ্গে অধিবাসীদের সর্বশান্ত করে দেয়।

নদীর ভাঙ্গনের পাশপাশি পাহাড়ি ঢলে নিমজ্জিত করে দেয় লামা শহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। ক্ষয় ক্ষতির পরিমান দাড়ায় কোটি টাকারও বেশি। গত কয়েক বছরে অসংখ্য বাড়ি ঘর, সরকারি বেসরকারি স্থাপনা, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভাটর্, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, ক্যায়াং ও লামা শহর এলাকায় প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাল নাগাদ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদী ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে। এর মধ্যে সদ্য নির্মিত কোটি টাকা ব্যয়ে অংহ্লাপাড়া ব্রীজটিও ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে। লামা পৌর শহরের বাজারপাড়া, উপজাতিদের শশ্মান, শীলেরতুয়া মার্মাপাড়া, লাইনঝিরি ফকিরপাড়া, কুড়ালিয়ারটেক, স’মিল পাড়া, নয়াপাড়া, লামামুখ, রুপসীপাড়া ইউনিয়নের অংহ্লাপাড়া, উত্তর দরদরী নয়াপাড়া, মাষ্টার পাড়া, লামা সদর ই উনিয়নের মেরাখোলা, মিশনঘাট, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজার এলাকাসহ বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে প্রমত্তা মাতামুহুরী। এসব স্থানে আরো শত শত পরিবার নদী ভাঙ্গন আতংকে দিন যাপন করছে।

স্থানীয় অভিজ্ঞ মহল জানায়, গত তিন দশকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, তামাক চাষ, পাথর আহরণসহ পরিবেশ বিদ্ধেষী কর্মকান্ডের ফলে নদীর নাব্যতা অস্বাবাভিক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে কয়েক ঘন্টা টানা মূসলধারে বৃষ্টি হলে পৌর এলাকাসহ বিশাল জনবসতি, উপজেলা প্রশাসন ও বাণিজ্যিক এলাকা ৫-১০ ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায়। এসময় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ার পাশা-পাশি দুই হাজার একর ক্ষেতের ফসল জলমগ্নতার কারণে পলিচাপা পড়ে ক্ষতিসাধিত হয়। লামা বাজার স’মিল পাড়ার বাসিন্দা আলী আকবর, মোহাম্মদ শাহীন, গৃহবধূ হোসনে আরা খুশু জানান, এক সময় ঘর থেকে নদী ছিল অনেক দূর। প্রতি বছর অব্যাহত ভাঙ্গনে এখন বাড়ি ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার কাছাকাছি। মনে হচ্ছে আগামী দু’এক বছরের মধ্যেই ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। তাই জরুরী ভিত্তিতে নদী ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে লামা পৌর শহর এলাকা। মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তন করে আমাদেরকে ভাঙ্গন ও বন্যামুক্ত করার জন্য পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বান্দরবান জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক এম রুহুল আমিন ও লামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক নবীর উদ্দিন বলেন, লামাকে বন্যামুক্ত ও ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রস্তাবিত পথে মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের বিকল্প নেই। উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের সাপমারা ঝিরি পয়েন্টে নদীর গতি পরিবর্তন করা হলে যেমন বন্যামুক্ত হবে লামা পৌর শহর অপরদিকে, নদীর বিশাল এলাকা জুড়ে মৎস্য চাষ ও পর্যটন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। সূত্রে জানাযায়, ১৯৯৩ সালে নদীর ভাঙ্গন ও লামাকে বন্যা মুক্ত করার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়। পি.এম’র স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে সচিব পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড ওই সময় একটি প্রকল্প গ্রহন করে প্রাক্কলন তৈরি করেছিল। প্রায় দু’যুগ সময় অতিবাহিত হতে চললেও সেই কাগজে প্রাক্কলনের এখন পর্যন্ত বাস্তবের মুখ দেখেনি এলাকাবাসী। মাতামুহুরী নদীর তীব্র ভাঙ্গনের সত্যতা স্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান উপ-প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতামুহুরী নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি সরজমিন তদন্ত পুর্বক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।