07-01-16-PM_Bangabandhu Krishi Podok-3

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৭ জানুয়ারি ২০১৬: সহজ শর্তে কৃষি ঋণ দেওয়ায় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েন শেষে নিজেদের টাকায় স্বপ্নের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওই ‘শিক্ষা’র পর বাংলাদেশকে আর কেউ অবহেলা করতে পারবে না।তনি বলেন, বাংলাদেশ আর কারো কাছে মাথা নোয়াবে না।বাঙালি জাতিকে আর যেন কেউ কখনো অবহেলা দেখাতে না পারে। আমার মনে হয়,আর কেউ দেখাবে না।কারণ সেই শিক্ষা তারা পেয়ে গেছে,পদ্মা সেতু নিয়ে।বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২০ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

কৃষিতে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ধান-মাছসহ কৃষিতে আমাদের একটা সম্মানজনক অবস্থান আমরা দাঁড় করাতে পেরেছি। শুধু যে ধান উৎপাদন বাড়িয়েছি তা নয়, সব কিছুর উৎপাদন বাড়িয়েছি।পুরস্কারের জন্য নির্বাচিতদের অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা জানতেন কৃষি উন্নয়নের মাঝেই এ দেশের সার্বিক উন্নয়নের বীজ নিহিত রয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, কৃষিকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্য দেখিয়ে ভিক্ষা করে আমরা খেতে চাই না। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো। কারো কাছে হাত পাতবো না।কারণ, আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। বঙ্গবন্ধু কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি সুলভমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠনের পর আমরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে আধুনিক এবং সুসংগঠিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করি। ফলে মাত্র ৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এজন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আমাদের সেরেস পদকে ভূষিত করে।এ সময় প্রধানমন্ত্রী কৃষি উন্নয়নে তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিগত সাত বছরে ভর্তুকি বাবদ মোট ৫১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের জন্য বিগত সাত বছরে প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি হিসেবে ৪৭৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হয়।আমরা কৃষকদের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড চালু করি। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সরকারি প্রণোদনাসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদানে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করি।’

সরকারের পাশাপাশি কৃষিখাতে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আমাদের প্রচলিত ‘ভাসমান সবজি চাষ পদ্ধতি’কে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতির স্বীকৃতি দিয়েছে- যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির’ অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শুরু হয় দীর্ঘ টানাপড়েন। পরে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে না বলে দেয়; নিজস্ব অর্থে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ এবং নদী শাসনের কাজের উদ্বোধন করেন।

প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেতু নিমির্ত নির্মাণ হলে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দেশের ১৯টি জেলা। ছয় দশমিক এক পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু বাংলাদেশ সরকারে অর্থায়নে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ২০১৪ বিতরণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, যখন তারা আমাদের অপমানজনক মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে টাকা প্রত্যাহার করল, যখন আমি ঘোষণা দিলাম নিজেস্ব অর্থায়নে করব, তখন দেশবাসীর কাছ থেকে আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম, যা আমার মনবোলকে অনেক বেশি শক্তিশালী করেছিল। আর কারও কাছে মাথা নত না।২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী পালনের আশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিভিন্ন শস্যের প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশ প্রতিরোধ সক্ষম জাত উদ্ভাবন করছেন।এতে করে চরাঞ্চলে ভুট্টা ও সবজি চাষ, পাহাড়ে ফল চাষ, জলাভূমিতে ভাসমান সবজি চাষ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বিএডিসির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পেরেছি। কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা দেওয়া ও গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার এবং বহুমুখী শষ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষার তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।

গ্রামকে অর্থনীতির প্রাণ হিসাবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি দিন দিন আরও বেশী উন্নত হচ্ছে।আয় বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে।বিনিয়োগের একটি বড় অংশ কৃষিভিত্তিক শিল্পে হওয়া উচিত মন্তব্য করে সরকার প্রধান কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপরও গুরুত্ব দেন।কৃষির উন্নয়নে তার সরকারের সফলতার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত সাত বছরে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ মোট ৫১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

কৃষকদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের জন্য বিগত সাত বছরে প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি হিসেবে ৪৭৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে।শেখ হাসিনা জানান, বর্তমানে কেজি প্রতি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা, ডিএপির দাম ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খামার যান্ত্রিকীকরণের জন্য ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।২০০৫-০৬ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৭৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা তিন কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। গতবছরই বাংলাদেশ প্রথম চাল রপ্তানি শুরু করেছে।

কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করতে ১৯৭৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু পুরস্কার তহবিল’ গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই পুরস্কার বিতরণ আবার শুরু করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতা বদলের পর ২০০২ সাল থেকে তা পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা পুনঃপ্রবর্তন করে।

মোট দশটি ক্ষেত্রে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলা ১৪১৯ সাল পর্যন্ত ২১ বারে ৯৭৭ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই সময়ে ৫৫টি স্বর্ণ, ৩৩০টি রৌপ্য এবং ৫৯২টি ব্রোঞ্জ পদক দেওয়া হয়েছে। ১৪২০ সালে কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন খাতে অবদানের জন্য ২৮ জন ব্যক্তি এবং চারটি প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ দেওয়া হয়। পাঁচটি স্বর্ণ, নয়টি রূপা এবং ১৮টি ব্রোঞ্জ পদক পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদী পশু ও হাস-মুরগি পালনের জন্য পাবনার মোসাম্মৎ নুরুন নাহার বেগম, কৃষি সম্প্রসারণে অবদানের জন্য চাঁদপুরের উত্তর মতলবের কৃষি অফিসার আবদুল কাইয়ুম মজুমদার, কৃষিতে নারীর অবদানের জন্য যশোরের মণিরামপুরের নিভা রাণী বিশ্বাস এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার শক্তি কির্ত্তনীয়া স্বর্ণ পদক পেয়েছেন।

এছাড়া কৃষি গবেষণায় অবদানের জন্য গাজীপুরের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটকেও স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।তারা প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সোনার একটি মেডেল, ২৫ হাজার টাকার চেক এবং সনদপত্র নেন। রৌপ্য পদকপ্রাপ্তরা মেডেল ও সনদপত্রের সঙ্গে ১৫ হাজার টাকা এবং ব্রোঞ্জ পদকপ্রাপ্তরা সাত হাজার ৫০০ টাকার চেক পেয়েছেন।কৃষিমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মতিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক।কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।