শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়া রন্দ্রে রন্দ্রে অনিয়ম দুর্নীতিতে নিমজ্জিতÑ বিদেশগামী ৯০% পুরুষ অভিবাসীই পদে পদে এ দুর্নীতির শিকার হন বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।বৃহস্পিতবার দুপুরে রাজধানী মাইডাস সেন্টারে শ্রম অভিবাস প্রক্রিয়া বিষয়ক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে করে বাংলাদেশের ‘শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রের বিভিন্ন দিক সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হয়।

ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, এ গবেষণা করতে টিআইবি সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, রিক্রুটিং এজেন্ট, দালাল, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্যপরীক্ষা কেন্দ্রসহ বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।২০১৬ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ শেষে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়।এ দুর্নীতির সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে দালালসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসের কর্মকর্তারা জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। মুলত আইনি দুর্বলতা ও অস্পস্টতা এবং দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার কারনে অভিবাসারী দুর্নীতিবাজদের খপ্পরে পড়েন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাওয়া পুরুষ কর্মীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার টিআইবি।২০১৬ সালে গন্তব্যের এসব দেশগুলোতে ভিসা ক্রয় বাবদ পাঁচ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে বলেও নিজেদের পরিচালিত গবেষণায় উঠে আসার কথা বলছে জার্মানভিত্তিক দ্র্নুীতি গবেষণার এই সংস্থা।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিবাসন কর্মীর চাহিদার চেয়ে বাংলাদেশে সরবরাহ বেশি। প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে কর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কাতার, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ থেকে মোট পুরুষ কর্মী গেছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ৭৬৯ জন, যার ৯০ ভাগই দুর্নীতির শিকার।এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিনামূল্যে নারী কর্মী পাঠানোর নিয়ম থাকলেও দালালরা জনপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা আদায় করে।বিদেশ গমনেচ্ছুদের পুলিশি ছাড়পত্র পেতে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূত অর্থ দিতে হয়। এই ছাড়পত্র সংগ্রহের জন্য জনপ্রতি ৫০০-১০০০ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

শ্রম অভিবাসন খাতে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে দাবি করে বিদেশ গমনেচ্ছুদের ভোগান্তি শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ করেছে টিআইবি।সংস্থাটি বলছে, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ডাটাবেইজে বায়োমেট্রিক পরিচয় দিতে একজন কর্মীকে একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়।ভিসা সংগ্রহ থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র ও স্মার্টকার্ড পাওয়া পর্যন্ত ২৪ থেকে ২৭টি ধাপ পার হতে হয়, যার মধ্যে বিএমইটিকেই আছে নয় থেকে ১১টি ধাপ।গবেষণাপত্রে বলা হয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে দলীয় ভিসার ক্ষেত্রে নিয়োগের অনুমতি নিতে একটি চক্রকে ভিসাপ্রতি ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্রের অনুমোদন দিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিসাপ্রতি ১০০-২০০ টাকা আদায় করে। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে বিএমইটি ভিসাপ্রতি পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছে।বিদেশে কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি দালাল নির্ভর আখ্যা দিয়ে টিআইবি কর্মকর্তা ইফতেখরুজ্জামান বলেন, ইন্সুরেন্স কোম্পানির এজেন্টদের যেমন দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা হয়, এ খাতেও তেমন বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করার ওপরও জোর দেন তিনি।শ্রম অভিবাসন খাতে সুশাসন আনতে সরকারের প্রবল প্রচেষ্টা রয়েছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা রয়েছে, তবে অগারগতাও আছে।শ্রম অভিবাসন খাতে ‘বহুমুখী সিন্ডিকেট’ কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।টিআইবির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে শ্রম অভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও প্রকৃত নূন্যতম ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে এই ব্যয় ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়।

মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যেতেও সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ আট লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়।টিআইবি বলছে, ফিলিপাইনের একজন কর্মীকে ভিসা কিনতে যেখানে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না, সেখানে বাংলাদেশের একজন কর্মীকে খরচ করতে সাত থেকে ১৫ হাজার সৌদি রিয়াল।গন্তব্যের দেশগুলোতেই নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তারা ভিসা বা কাজের চাহিদাপত্র বিনামূল্যের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করছে, যা আইনত অবৈধ। এসব প্রতিষ্ঠান চাহিদার তুলনায় বেশি চাহিদাপত্র তৈরি করে তা বিক্রি করে। আর ভিসা বাণিজ্য নিষিদ্ধ হওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।শ্রম অভিবাসন খাতে সুশাসন নিশ্চিতে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। এছাড়া বিএমইটিরওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকর করারও ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। টিআইবি বলছে, পুরোপুরি দালাল নির্ভর এ প্রক্রিয়াটিতে দালালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। এজন্য তাদেরকে রিক্রুটিং এজেন্টদের সাব-এজেন্ট বা নিবন্ধিত প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে।একইসঙ্গে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের নূন্যতম পাঁচগুণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।