অপেক্ষার সময় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে; উন্নয়নের বিড়ম্বনা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। অবশেষে উদ্বোধনের পর পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার দুপুরে গণভবন থেকে এ ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, এই ফ্লাইওভার যানজট কমিয়ে মানুষের সময় বাঁচাবে; কর্মচাঞ্চল্যও বাড়বে। খুলে গেল মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই উড়ালসড়ক যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে। সময় বাঁচাবে। কর্মচাঞ্চল্য বাড়বে।সাড়ে ১২টার দিকে উড়ালসড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। উড়ালসড়ক নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। উড়ালসড়কসহ সব সড়ক ব্যবহারে যতœবান হতে ও ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার জন্য আহ্বান জানান।ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আধুনিক যুগে আর্থিক ক্ষমতা থাকলে মানুষ গাড়ি কিনছে। ফলে যানজট বাড়ছে। মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কে গাড়ি দ্রুত চলবে। চলাচলের সুবিধার জন্য এই উড়ালসড়কের কিছু জায়গায় নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে।

উড়ালসড়কটি তিন ভাগে করা হয়েছে। একটি অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। এটা নির্মাণ করেছে নাভানা কনস্ট্রাকশন। গত বছরের মার্চে এই অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর নিউ ইস্কাটন থেকে মৌচাক পর্যন্ত উড়ালসড়কের এক দিক খুলে দেওয়া হয়। এই অংশ নির্মাণ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) মোড় থেকে কারওয়ান বাজার অংশ যানবাহন চলাচলে খুলে দেওয়া হয় ১৭ মে। এই অংশও তৈরি করেছে নাভানা কনস্ট্রাকশন। এখন খুলে দেওয়া হলো উড়ালসড়কের মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ-মগবাজার অংশ। এটা নির্মাণ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন।চার লেনের এই উড়ালসড়ক ছয়টি মোড় অতিক্রম করেছে। এগুলো হলো সাতরাস্তা, বিএফডিসি, মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর ও মালিবাগ মোড়। এর মধ্যে মগবাজার, মালিবাগ ও কারওয়ান বাজারে রেললাইন অতিক্রম করেছে এই উড়ালসড়ক প্রকল্প।আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দৈনিক ৫০ হাজার যানবাহন এই ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে পারবে। নিচের সড়ক ব্যবহার করা যাবে আগের মতোই।গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী যখন ফ্লাইওভারের উদ্বোধন ঘোষণা করেন, মৌচাক এলাকায় বানানো অনুষ্ঠান মঞ্চে তখন উল্লাসে মেতে ওঠেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, খাদ্য মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ছিলেন সেখানে।উদ্বোধন ঘোষণার কিছুক্ষণ পর বেলা ১টার দিকে নানা রঙের পতাকা আর লাল-সবুজ কাপড়ে সাজানো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়।২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালে যখন এই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এরপর কয়েক ধাপে তা বেড়ে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৬৯ লাখ টাকায় পৌঁছায়।সব মিলিয়ে ৮ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেনের এ ফ্লাইওভারে ওঠা-নামার জন্য তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা (হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তা), বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও শান্তিনগর মোড়ে লুপ বা র‌্যাম্প রাখা হয়েছে।ঢাকার কেন্দ্রভাগে অন্যতম ব্যস্ত এবং চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই নির্মাণকাজের জন্য ছয় বছর দারুণ ভোগান্তি পোহাতে হয় স্থানীয় বাসিন্দা ও চলতি পথের যাত্রীদের। বেহাল রাস্তার কারণে মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর এলাকার বিপণি বিতান ও দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা হন ক্ষতির শিকার।প্রতিদিন চলাচলের দুর্ভোগে পড়ে অনেকেই ওই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বাসা নেওয়ায় স্থানীয় ভবনমালিকদেরও বিপাকে পড়তে হয়।ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলার মধ্যেই চলতি বছর মার্চে মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যু হয়; আহত হন আরও দুইজন।শহীদবাগের বাসিন্দা ইকরাম হোসেন বুধবার বলেন, এ কয়েকটা বছর কতটা যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে আমাদের, সেটা আমরাই জানি। যানজটে যে কত সময় নষ্ট হয়েছে! আর ফ্লাইওভার নির্মাণে যে সময় নিছে, এত সময় তো নেওয়ার কথা না।নির্মাণ কাজ শুরু করার পরপরই এ ফ্লাইওভারের নকশার ত্র“টি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন আসে সংবাদমাধ্যমে, যার সুরাহা আর হয়নি।বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখে বিদেশি প্রকৌশলীর করা নকশায় নির্মিত এ উড়াল সড়কে ডানে যাওয়া বা রাইট টার্নের ব্যবস্থা না রাখা, ওঠা-নামার র‌্যাম্প জটিলতাসহ বেশ কিছু ত্রুটির কথা সে সময় বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।ফলে অনেক ধকলের পর এই ফ্লাইওভার বাস্তবে কতটা সুবিধা দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের মনে। মৌচাকের আনারকলি সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. বেলাল হোসেন বলেন, প্রশাসন যদি বড় বাস এবং প্রাইভেট কারগুলো ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়, তবে যানজট কমবে। ফ্লাইওভারের কারণে রাস্তা ছোট হয়ে গেছে, সেজন্য রিকশা-অটোর বাইরে বড় গাড়ি নিচ দিয়ে চলাচল করলে যানজট কখনোই কমবে না।

আর এনজিও কর্মকর্তা ইকরাম হোসেন বলেন, ফ্লাইওভারের উপরে আবার সিগন্যাল বাতি, সিগন্যালে যদি গাড়ি আটকায়, তাহলে ভালো কী হল? সেই আগের অবস্থাতেই তো আছেন।সড়কের পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় থাকলেও শত ভোগান্তি পেরিয়ে আসা স্থানীয় বিপণি বিতানগুলোর ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, ফ্লাইওভারের কল্যাণে যদি যানজট কমে, তাহলে তাদের ব্যবসার সুদিনও ফিরবে।ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ করা হয়েছে তিন ভাগে। একটি অংশে রয়েছে সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত, আরেকটি অংশে শান্তিনগর-মালিবাগ-রাজারবাগ পর্যন্ত এবং শেষ অংশটি বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক পর্যন্ত।এর মধ্যে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত অংশটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ ফ্লাইওভারের ইস্কাটন-মৌচাক অংশের যান চলাচল উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।আর ফ্লাইওভার থেকে সোনারগাঁও হোটেলের দিকে নামার র‌্যাম্পটি গতবছর ১৭ মে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এর নির্মাণ কাজ করে।